চট্টগ্রামে ব্যবসায় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের টাকায় মেয়রের বিদেশ সফর

মো. রেজাউল করিম চৌধুরী

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ফিনল্যান্ডের হাবা গ্রুপ। গত বছরের ২৩ আগস্ট মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে এ গ্রুপের একটি প্রতিনিধিদল। এ সময় তারা বিশদ পরিকল্পনা উপস্থাপন করে মেয়রের কাছে।

এই সাক্ষাতের আড়াই মাস পর গত বছরের ৫ নভেম্বর ১০ দিনের জন্য ফিনল্যান্ড সফরে যান মেয়র। সঙ্গে ছিলেন মেয়রের একান্ত সচিব ও তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা অফিস আদেশে বলা হয়, এই সফরের যাবতীয় খরচ বহন করবে ফিনল্যান্ডের হাবা গ্রুপ।

সিটি করপোরেশনে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের টাকায় মেয়রের বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ধরনের বিদেশ সফরের প্রবণতাকে অনৈতিক বলছেন স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাঁদের মতে, এটা খারাপ দৃষ্টান্ত। মেয়র কেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের টাকায় বিদেশ সফর করবেন?

এমন প্রশ্ন উঠলেও মেয়র রেজাউল করিমের বিদেশ সফর থেমে নেই। দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের খরচে তিনটি দেশে সফর করেছেন তিনি। দেশগুলো হচ্ছে ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। এর বাইরে আরও চারটি দেশে ব্যক্তিগত সফরে গেছেন তিনি। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও ভারত। ভারত সফরে মেয়রের সঙ্গে ছিলেন সিটি করপোরেশনের দুই ঠিকাদার। বিদেশ ভ্রমণের জন্য দেশের বাইরে ছিলেন অন্তত ৭৪ দিন।

সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, মেয়রের এসব সফরে সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারি তহবিল থেকে কোনো টাকা ব্যয় হয়নি।

নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব নেন ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। দায়িত্ব নেওয়ার পর একের পর এক বিদেশ সফর করেন তিনি। তবে তাঁর পূর্বসূরিদের মধ্যে এই প্রবণতা কম ছিল। ছয় মাসের জন্য প্রশাসকের দায়িত্ব পাওয়া নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন দেশের বাইরে কোনো সফরে যাননি। এর আগের মেয়র নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে বিদেশ সফরে যান পাঁচবার। তার মধ্যে ব্যক্তিগত সফর ছিল তিনটি। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ মনজুর আলম ওমরাহ করতে একবার ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন।

মনজুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র থাকাকালে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে বিদেশ সফরের অনেক আমন্ত্রণ এলেও তিনি যাননি। তবে সিটি করপোরেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে সেখানে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। মেয়র বারবার বিদেশ সফর করলে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম ও সেবা ব্যাহত হয় বলে মনে করেন তিনি।

সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি তহবিলের টাকায় বিদেশ সফরের বিষয়ে অর্থ বিভাগের নিষেধাজ্ঞা আছে। যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা আমন্ত্রণ জানায়, তারা যাবতীয় খরচ বহন করে। মেয়রের বিদেশ সফরে সিটি করপোরেশন বা সরকারের টাকা ব্যয় হয়নি।

তবে সিটি করপোরেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের টাকায় মেয়র ও কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করছেন, সে প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সিটি করপোরেশনের কোনো প্রকল্পের কাজ পায়, তাহলে বিদেশ সফরের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ বিষয়ে মেয়রের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

ব্যবসায় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের টাকায় সফর

জাপানের সংগঠন দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর ওভারসিজ টেকনিক্যাল কো–অপারেশন অ্যান্ড সাসটেইনেবল পার্টনারশিপসের (এওটিএস) আমন্ত্রণে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে চারজনের একটি দল জাপান সফরে যায় গত ২১ এপ্রিল। ১২ দিনের এ সফরে মেয়রের সঙ্গে ছিলেন উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ, মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জারি করা অফিস আদেশে বলা হয়েছে, এ সফরের যাবতীয় ব্যয় বহন করবে এওটিএস। সফরের আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এওটিএস সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। টোকিও সিটি করপোরেশন কীভাবে পরিচালিত হয়, তা দেখানো হবে তাঁদের।

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী গত বছরের ৫ নভেম্বর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দেখতে ফিনল্যান্ড যান। ১০ দিনের এ সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন একান্ত সচিব আবুল হাশেম। এ সফরে অর্থায়ন করে হাবা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে আগ্রহী। বিশেষ করে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ভূগর্ভস্থ বর্জ্য সংরক্ষণাগার করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। সিটি করপোরেশনও প্রতিষ্ঠানটিকে এ কাজের অনুমতি দিতে নীতিগতভাবে রাজি বলে জানা গেছে।

মেয়র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অপসারণ কার্যক্রম দেখতে গত বছরের ১০ জানুয়ারি গিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়া। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও একান্ত সচিব আবুল হাশেম। এক সপ্তাহের এ সফরের ব্যয় বহন করে দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠান কোরীয় এনভায়রনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (কেইআইটিআই)।

এ সফরের পর গত বছরের ২৫ জানুয়ারি সিটি করপোরেশন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, মেয়র ও করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা কোরিয়ার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন। কেইআইটিআই সিটি করপোরেশনের কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ২০২৪ সালে ১৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনুদান দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মেয়র কোরিয়ার সহায়তায় এই প্রকল্প নেওয়ার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

মেয়রের একান্ত সচিব ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা আবুল হাশেম তিনটি সফরে ছিলেন। তাঁর দাবি, এসব সফরের কারণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন উপকৃত হতে যাচ্ছে। কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানটি সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাই করেছে। এটি এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। আর ফিনল্যান্ডের হাবা গ্রুপ ভূগর্ভস্থ বর্জ্যাগার নির্মাণ করতে চায়। এটিও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

ব্যক্তিগত সফরে পাশে ছিলেন ঠিকাদারেরা

২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত সফরে ভারত সফরে যান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। ওই সময় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, মেয়র চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করার আগে একটি ছবি মেয়রের ফেসবুক পাতায় দেওয়া হয়। ছবিতে তাঁর দুই পাশে সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাবেদ নজরুল ইসলাম আর কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরীকে দেখা যায়। মাসুম দীর্ঘদিন ধরে সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ইয়ারসিব ট্রেড ক্যাসেল।

আর সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণের দায়িত্ব পেয়েছিল জাবেদ নজরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সোর্স।

‘খারাপ দৃষ্টান্ত’

মেয়রের ঘন ঘন বিদেশ সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র ব্যক্তিগত সফরে যেতে পারেন। তবে যখন দাপ্তরিক সফরে যাবেন, তখন সিটি করপোরেশনের স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত হবে, তা দেখা উচিত। আর যারা প্রকল্পের কাজ করবে, তাদের টাকায় কেন মেয়র বিদেশে যাবেন? কোম্পানিগুলোর স্বার্থ কী? তারা কেন টাকা খরচ করে মেয়রকে বিদেশে নিয়ে যাবে? এটা খারাপ দৃষ্টান্ত। তা ছাড়া মেয়র না থাকলে নগরবাসী সেবা থেকে বঞ্চিত হন। এ ধরনের বিদেশ সফরের প্রবণতা খারাপ। বিপদও বটে।