প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা চলছে ‘দয়া’ ও ‘স্বেচ্ছাসেবায়’

দেশে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

ফাইল ছবি

দেশের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল ২০১৩ সালে করা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে। যদিও স্কুলগুলোতে সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোতে ভর্তিই নেওয়া হয় না।

সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য কিছু ব্যবস্থা আছে। তবে তা সীমিত। যেমন সমাজসেবা অধিদপ্তর ৬৪টি জেলায় ৬৪টি সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে, যেখানে আসন ৬৪০টি। আর ৮টি জেলায় পরিচালিত শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৭২০টি।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষার্থীদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি স্কুল রয়েছে। অন্যান্য জেলায় নেই। আর বেসরকারিভাবে পরিচালিত ৭২টি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হয়। এর বাইরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১ লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে মাসে ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা উপবৃত্তি দেওয়া হয়।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটাই দয়াদাক্ষিণ্য ও স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে চলছে। বিশেষ করে যারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, তাদের শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সীমিত।
জওয়াহেরুল ইসলাম, মেন্টর, সুইড বাংলাদেশ

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি।

১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সুইড বাংলাদেশ। সুইডের মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটাই দয়াদাক্ষিণ্য ও স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে চলছে। বিশেষ করে যারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, তাদের শিক্ষার সুযোগ একেবারেই সীমিত। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই পরিচালিত হওয়া উচিত।

আজ ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবস ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ: প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা’।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯১–এ। ২০২২ সালের জনশুমারি প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে।

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। অটিজম, শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৩ সালে নতুন আইন করা হয়। তাঁদের বিষয়ে একাধিক নীতিমালাও রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আইন ও নীতিমালা কাগজেই আটকে আছে, বাস্তবায়ন কম।

কখনো কখনো শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার পরও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী শারীরিক প্রতিবন্ধী হৃদয় সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ইচ্ছা ও যোগ্যতা থাকার পরও তিনি জাপানি ভাষা বিষয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের উচ্চতর কোর্সে ভর্তি হননি। কারণ, ভাষা ইনস্টিটিউটের ভবনে লিফট নেই।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ আছে ই-লার্নিং মাধ্যম ‘মুক্তপাঠে’। সরকারের উদ্যোগে অ্যাসপায়ার টু ইনোভেটের (এটুআই) মাধ্যমে
এটি তৈরি।

এটুআইয়ের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (অ্যাকসেসিবিলিটি) ভাস্কর ভট্টাচার্য। তিনি নিজেও একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি। ভাস্কর প্রথম আলোকে বলেন, সমাজসেবার স্কুলে পড়লেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দিন শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষা নীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। শিক্ষা অধিকার, কিন্তু এখনো দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টি কল্যাণের দৃষ্টিতে দেখা হয়।

এদিকে আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষে (২০২৩ সালে) প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া বই প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

ব্যবস্থা যতটুকু আছে, তা থেকেও বঞ্চিত থাকে মূলত দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুরা। রাজধানীর দোলাইরপারের মাসুম মিয়া জানান, তাঁর ১১ বছর বয়সী এক সন্তান অটিস্টিক। সে একসময় গেন্ডারিয়ার একটি স্কুলে যেত। বাসা থেকে দূরত্বের কারণে এখন আর স্কুলে যাচ্ছে না।

মাসুম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করার সুযোগ নেই। কাছাকাছি দূরত্বে কোনো বিশেষ স্কুল থাকলেও ভর্তি করতাম।’