অর্থকষ্টে থাকা সার্জানার কাছে পড়াশোনা হয়ে ওঠে ‘বিলাসিতা’, তিনিই পেলেন ডিনস অ্যাওয়ার্ড

এক কক্ষে থাকতেন চারজনের পরিবার। বাবার ঘুম ভেঙে যাবে তাই বাতি নিভিয়ে মোবাইলের আলোয় পড়তে হতো সার্জানা আক্তারের। তিনিই এবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ থেকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেনছবি: সংগৃহীত

আহা যদি ‘ডিনস মেরিট অ্যাওয়ার্ড’টা পেতাম—বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই এমন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন সার্জানা আক্তার। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ থেকে (স্নাতকে সিজিপিএ–৩ দশমিক ৯৬৫, চতুর্থ স্থান) সার্জানা এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। অথচ পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় পড়তে পারবেন কি না, সেটাই বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সার্জানার।

সার্জানার বাবা মো. বাবুল হোসেন ঢাকায় একটি কোম্পানিতে গাড়ি চালান। মা শাহনাজ বেগম গৃহিণী। সার্জানার আরেক বোন সাবিকুন নাহার বিএএফ শাহীন কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মেয়ের পড়াশোনার বিষয়ে অটল ছিলেন বাবা–মা। আর্থিকভাবে সার্জানার নিজের খালু, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী, বেসরকারি সংগঠন মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিরা এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের সহায়তায় এই পর্যন্ত আসা সার্জানা এখন স্বপ্নের পরিধিকে আরও বড় করার সাহস পাচ্ছেন।

এইচএসসির পর সার্জানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ (ডেন্টাল ইউনিট) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। তিনি বেছে নেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। স্নাতকোত্তরের প্রথম সেমিস্টারে সিজিপিএ–৪ পেয়েছেন। আর দুটি সেমিস্টারে সিজিপিএ–৪ পেলেই পাবেন স্বর্ণপদক, আপাতত সে স্বপ্নের পেছনে ছুটছেন তিনি।

সার্জানার বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জে। সেখানে দাদার সূত্রে পাওয়া শুধু একটু ভিটা আছে। সেই ভিটায় কোনো ঘর তুলতে পারেননি সার্জানার বাবা। সার্জানা ও তাঁর বোন ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছেন।

সময়টা কঠিন গেছে, এখনো যাচ্ছে

আলাপচারিতায় ঢাকা শহরে অনেক কষ্ট করেও লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার গল্প শোনালেন সার্জান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে আমাদের টিকে থাকাটাই এত কঠিন হয়ে পড়েছিল যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা বিলাসিতার মতো হয়ে উঠেছিল। সাবলেটে এক রুমে আমরা চারজন থেকেছি। সম্প্রতি দুই রুমের একটি বাসায় থাকছেন বাবা, মা ও ছোট বোন। এক রুমে থাকতে গিয়ে আমাদের প্রাইভেসি বলতে কিছু ছিল না। তার থেকেও বড় কথা, বাবা সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করে রাতে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে যেতেন। তখন লাইট জ্বালিয়ে পড়তে পারতাম না। মাঝেমধ্যে মোবাইলের ছোট টর্চ জ্বালিয়ে পড়তাম, তা না হলে সকাল হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। আর খাওয়াদাওয়ার যে কষ্ট ছিল, তা কেমন যেন আমাদের সহ্য হয়ে গিয়েছিল।’

যে মানুষকে স্বপ্ন দেখা সাজে না, সেই মানুষটাই স্বপ্ন দেখে বসে আছেন—মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চশিক্ষিত করার যে স্বপ্ন বাবা দেখেছিলেন, সেটাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন সার্জানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘বাবা চাকরির সুবাদে একটা বিষয় অনুধাবন করলেন যে তাঁর স্যারের ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে পড়াশোনা করছে, ভালো পরিবেশে বড় হচ্ছে। বাবারও ইচ্ছে হলো তাঁর মেয়েদেরও এমন করে বড় করবেন। সামর্থ্যে না থাকলেও ঢাকার নামকরা সরকারি স্কুলে আমাকে ভর্তি করান ও অফিসার্স কোয়ার্টারে সাবলেট হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।’

অতিথিদের কাছ থেকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছেন সার্জানা আক্তার। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন স্নাতকোত্তরে ভালো ফল করে স্বর্ণপদক পাওয়ার
ছবি: সংগৃহীত

সার্জানা জানালেন, তাঁর বাবা স্বপ্নপূরণে অনেক কিছুই করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। একসময় রাজধানীতে পরিবার নিয়ে টিকে থাকা, মেয়েদের পড়ার খরচ চালানোটাই প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে মেয়েদের পড়াতে পারবেন কি না, তাই নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তবে বাবা ও মা সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে কোনোভাবেই মেয়েদের পড়া থামানো যাবে না।

অনেকেই এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন

সার্জানা বলেন, ‘পড়াশোনায় মেধাবী ও মনোযোগী হওয়ায় প্রতিবেশীসহ সবাই আমাকে ভালোবাসতেন। আমি মানুষের দোয়া পেয়েছি। শিক্ষক, আশপাশের অনেক মানুষ এগিয়ে এসে আমার ও আমার বাবার হাতটি ধরেছেন বলেই আমি আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। উচ্চমাধ্যমিকে কয়েকজন শিক্ষক সম্পূর্ণ বিনা খরচে আমার টিউশনের দায়িত্ব নেন। খরচ বেশি হওয়ায় বিজ্ঞান বিভাগ পাল্টে মানবিক বিভাগে পড়ব কি না, এমন টানাপোড়েনও ছিল।’

অভাব তো আর পিছু ছাড়েনি। এর মধ্যে সার্জানার বাবা অসুস্থ হয়ে যান। বাবার ওষুধ কেনাটাই কঠিন হয়ে যায়। সার্জানা বলেন, ‘বাবার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। বাবা চিকিৎসা না করে স্যাক্রিফাইস করছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই ড্রাইভিংয়ের মতো কঠিন চাকরি করে যাচ্ছেন।’

ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাজ করছেন উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সার্জানা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

পদে পদে পরিবারটি দিশাহারা হয়ে পড়েছিল উল্লেখ করেন সার্জানা। জানালেন, তাঁর বাবার এক বন্ধু একজনের গাড়ি চালান। বাবার মুখ থেকে সংগ্রামের কথা শুনে বাবার ওই বন্ধু গাড়ির মালিককে বলেছেন সার্জানার কথা।

সার্জানা বলেন, ‘আমার কলেজের একজন প্রাক্তন তাহমিনা হাসান (আন্টি) আমার সিভি দেখতে চান। সিভিতে হলিক্রস কলেজ দেখেই হয়তো আমার দায়িত্ব নিয়ে নেন। এইচএসসিতে পড়ার সময় আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিকভাবে সহায়তা করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।’

সার্জানা জানালেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। বললেন, হোস্টেলে থাকা–খাওয়াসহ খরচ তো অনেক। কিন্তু এ বাড়তি টাকা বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। তখন খুঁজে খুঁজে যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধন করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট চন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলেন। স্নাতকের শেষ পর্যায় থেকে এখন পর্যন্ত ফাউন্ডেশন থেকে প্রতি মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা বৃত্তি পাচ্ছেন। এ টাকাটা না পেলে হয়তো তাঁকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো।

একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত মো. খায়রুজ্জামান সার্জানার খালু। সার্জানাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন, ‘আম্মু’ বলে ডাকেন। সার্জানা বলেন, ‘কলেজে ভর্তি বা বড় কোনো খরচ সামনে এলেই খালু এসে পাশে দাঁড়ান। এখনো বৃত্তির মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকায় টান পড়লে বাকি টাকা খালু পাঠিয়ে দিচ্ছেন।’

পড়াশোনার পাশাপাশি সার্জানা আক্তার বিভিন্ন অলিম্পিয়াড, আবৃত্তি, উপস্থাপনাসহ নানা কিছুতে যুক্ত আছেন
ছবি: সংগৃহীত

পরিবারের ঢাল হয়ে দাঁড়াতে চান সার্জানা

সার্জানা নামের অর্থ সৃষ্টি। সার্জানা তাঁর পরিবারের জন্য নতুন কিছু করতে চান। ঢাল হয়ে দাঁড়াতে চান পরিবারটির পাশে। মায়ের প্রসঙ্গে সার্জানা বলেন, ‘যিনি আমাকে স্বপ্ন দেখান, তিনি আমার মা। আমার মা একজন স্বশিক্ষিত, সাবলীল মানুষ। তাঁর সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা ও যত্ন আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছে।’

সার্জানা বলেন, যে করেই হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। বাবা–মায়ের জন্য বাড়ি করে দেওয়া ছাড়াও অন্যান্য দায়িত্বও পালন করতে চান তিনি। তাঁর বাবার ছেলেসন্তান নেই, এ কথা বলে যাতে কেউ কখনো বাবাকে কথা শোনাতে না পারেন, তাই ছেলেসন্তান থাকলে যা করতেন, তাই করতে চান সার্জানা। বাবা-মা এ পর্যন্ত যা কষ্ট করেছেন, সেই কষ্টটা কমাতে চান।

পড়াশোনা শেষ করে সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে চান সার্জানা। গবেষণামূলক কাজে নিজেকে সংযুক্ত করা এবং উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন তো আছেই।

জীবনের কঠিন সময়ে যে মানুষগুলো সার্জানার পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সার্জানা। জানালেন, জীবনে যখন অভাব থাকবে না তখন এই মানুষগুলোর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। নিজের সামর্থ্যের মধ্যে উপহার দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

অন্যের সহায়তা পেয়ে সার্জানার জীবন পাল্টে গেছে—এটা কখনোই ভুলতে চান না সার্জানা। তাই তিনিও তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী এমন ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চান, যাতে তাদের জীবনটাও পাল্টানো সম্ভব হয়।

পড়াশোনার পাশাপাশি সার্জানা বিভিন্ন অলিম্পিয়াড, আবৃত্তি, উপস্থাপনাসহ নানা কিছুতে যুক্ত আছেন। তিনি বললেন, ‘আমি মোমবাতি হতে চাই, যে মোমবাতি অন্য অনেক মোমবাতিকে জ্বালাতে সহায়তা করবে।’

সার্জানা বললেন, ‘নিজের স্বপ্নকে জিইয়ে রাখা, বাবার স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেওয়া এবং স্বপ্নের প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করার চ্যালেঞ্জ আমার পিছু ছাড়েনি। মাঝে মাঝে হতাশ হলে পরক্ষণেই বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি—শেষটা দেখি, কত দূর যেতে পারি।’