জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অন্ধকারে ছেয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকা
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে মঙ্গলবার টানা চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল। কোথাও কোথাও আট ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎবিহীন থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন কয়েক কোটি মানুষ। এই বিপর্যয়ের উৎস ও কারণ জানতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি কাজও শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তবে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বিপর্যয়ের কারণ না–ও জানা যেতে পারে। সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারে তদন্ত কমিটি।

গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালনকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) গঠিত তদন্ত কমিটির দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিনটি বড় অঞ্চল ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ পরিদর্শন করার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় একসঙ্গে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, প্রাথমিকভাবে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। তাই শুরুতে বুধবার দুপুরে ঘোড়াশাল পরিদর্শন করেছেন তাঁরা। এরপর বিকেলে আশুগঞ্জ পরিদর্শনে যান। বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জ পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এরপর মাঠপর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।

পূর্বাঞ্চল গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে মঙ্গলবার বেলা ২টা ৫ মিনিটে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ বিভাগ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই দিন রাতেই পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। এতে পিজিসিবির পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রতিনিধি রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে বুধবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরীকে তদন্ত কমিটিতে যুক্ত করা হয়।

তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি জটিল। তদন্ত কমিটি কাজ শেষ করলে বোঝা যাবে। এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ক্লু (সূত্র) পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রহস্য উদ্‌ঘাটনে একটু সময় লাগতে পারে।

এদিকে বিপর্যয়ের পর বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে আরও দুটি তদন্ত কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। একটি বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের দিয়ে এবং আরেকটি তৃতীয় পক্ষ দিয়ে কমিটি গঠন করা হবে। তবে বুধবার রাত পর্যন্ত দুটির একটি কমিটিও গঠিত হয়নি।

পিজিসিবির দুজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেছেন, নানা কারণে বিদ্যুতের গ্রিডে বিপর্যয় হতে পারে। কারণ অনুসন্ধানে কখনো কখনো কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। এবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে অবকাঠামোগত কোনো ক্ষতি চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। তাই বিষয়টি আরও জটিল মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

বিদ্যুৎ বিপর্যয়: রাজধানীর রাস্তাঘাট অন্ধকার

এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ২ মিনিটে পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেয়। ২০১৭ সালের ৩ মে উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন ছিল। তবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালে। এতে গোটা দেশ প্রায় ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রতিবারই বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

পিজিসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রিড একটি স্পর্শকাতর বিষয়। নানা কারণে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিদ্যুতের ফ্রিকোয়েন্সিতে (কম্পাঙ্ক) সামান্য হেরফের; লাইনে ক্ষমতার চেয়ে কম বা বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হওয়া; এমনকি সক্রিয় লাইনে পাখি বসা, গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে বা কোনো জৈব পদার্থের সংস্পর্শ থেকেও গ্রিড বন্ধ হয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত গ্রিড বিপর্যয় হলে অবকাঠামোগত ক্ষতি চোখে পড়ে। এবারের বিপর্যয়ে তা দেখা যাচ্ছে না। তাই বিষয়টি একটু জটিল মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সাইবার থ্রেড ও কারিগরি ত্রুটি—এই তিন কারণে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। মঙ্গলবার যে বিপর্যয় ঘটেছে, তার কারণ বের করতে পুরো বিষয়টার একটা পূর্ণাঙ্গ স্টাডি ও বিশ্লেষণ করতে হবে। ছোটখাটো বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এমন বিপর্যয় ঘটে না। বড় একটা কেন্দ্র যদি গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে।