জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মাথার পেছনে রক্ত ঝরছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর বাবা মকবুল হোসেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া জবানবন্দিতে মকবুল হোসেন এ কথা বলেন।
আবু সাঈদ হত্যায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে মকবুল হোসেন ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, দাফনের জন্য গোসল করানোর সময় তিনি আবু সাঈদকে একবার দেখেছেন। তখন দেখতে পান, আবু সাঈদের মাথার পেছন থেকে রক্ত ঝরছে। বুকে গুলির চিহ্ন, সারা বুক দিয়ে রক্ত ঝরছে।
জবানবন্দিতে মকবুল হোসেন বলেন, আবু সাঈদ চাকরি করবে, এটা তিনি বেঁচে থাকতে দেখে যেতে চেয়েছিলেন। আর এখন তিনি বেঁচে থাকতে আবু সাঈদ হত্যার বিচার দেখে যেতে চান।
ঘটনার বিষয়ে জবানবন্দিতে মকবুল হোসেন বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই তিনি মাঠ থেকে বাসায় এসে দেখেন সবাই কান্না করছে। শোনেন, আবু সাঈদের শরীরে গুলি লেগেছে। একটু পর শোনেন, আবু সাঈদ মারা গেছে। এ খবর শুনে তাঁর মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে।
মকবুল হোসেন বলেন, তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের স্বামী আবু সাঈদের মরদেহ আনতে যান। তাঁরা মরদেহ নিয়ে দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাসায় আসেন। প্রশাসনের লোকজন রাতেই মরদেহ দাফনের জন্য বলে। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। পরদিন সকাল ৯টার দিকে দুই জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে ছেলের লাশ দাফন করেন।
জবানবন্দিতে মকবুল হোসেন বলেন, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক আমির হোসেন ও সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় তাঁর ছেলেকে গুলি করেছেন। এর কয়েক দিন আগে আবু সাঈদের গলা চেপে ধরে থাপ্পড় দিয়েছিলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া। তাঁর ছেলেকে যাঁরা শহীদ করেছে, তিনি তাঁদের বিচার চান।
আজ বেলা ১১টার দিকে এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বেলা ১টার দিকে ট্রাইব্যুনাল বিরতিতে যান। আবার বেলা ৩টার দিকে ট্রাইব্যুনাল বসবেন।
এই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার গতকাল বুধবার শুরু হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জন এই মামলায় আসামি।
আসামিদের মধ্যে সাবেক উপাচার্যসহ ২৪ জন পলাতক। অন্য ছয় আসামি কারাগারে আছেন। তাঁরা হলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।
গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাঁকে হত্যার ভিডিও সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ভিডিওতে দেখা যায়, আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন আর পুলিশ তাঁর বুকে একের পর এক গুলি করছে। এ হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় গত ২৪ জুন ৩০ জনকে আসামি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরে ৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
সংশোধনী
'আবু সাঈদের মাথার পেছনে গুলি ছিল, সারা বুক দিয়ে রক্ত ঝরছিল' শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সন্ধ্যা পৌনে ৮টার দিকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা প্রথম আলোর প্রতিবেদককে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, জবানবন্দিতে আবু সাঈদের মাথার পেছনে গুলি লাগার কথা বলেননি তাঁর বাবা মকবুল হোসেন।
জবানবন্দির সময় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের নোটে 'গুলি' শব্দটি লেখা রয়েছে। জবানবন্দির নোট নেওয়ার সময় প্রতিবেদক সঠিক লেখেছিলেন কিনা, তা যাচাই করার জন্য মকবুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। সে জন্য আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেনকে মুঠোফোনে কল করা হয়। জবানবন্দির সময় তিনি মকবুল হোসেনের সঙ্গে ছিলেন।
আবু হোসেন রাত পৌনে ১০টার দিকে প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বাবা তাঁর সঙ্গে নেই। তাঁকে আগেই গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে গ্রামে পৌঁছে গেছেন। সেখানে আপাতত যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। অন্য গণমাধ্যমেও আবু সাঈদের মাথার পেছনে গুলি লাগার সংবাদ দেখেছেন। তবে আবু সাঈদের মাথার পেছনে গুলি লাগার কথা তাঁর বাবা জবানবন্দিতে বলেননি।
এ অবস্থায় আবু সাঈদের মাথার পেছনে 'গুলি লাগার' তথ্যগুলো প্রতিবেদন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।