বিজয়ের বারতা সমাজের গভীরে পৌঁছাতে হবে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানপ্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের আনুষ্ঠানিকতার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের পেছনে এ যুদ্ধে তার আন্তর্জাতিক মিত্র চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রত্যাশা কাজ করেছিল। কিন্তু ভারত এবং জায়মান বাংলাদেশের পাশে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান তত দিনে কূটনৈতিক তৎপরতা ছাপিয়ে সামরিক সহায়তা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে দুই পরাশক্তি বড় ঝুঁকি নিতে চায়নি। যুদ্ধের মধ্যেই ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত ও ভুটান স্বীকৃতি দেয়। এবার শুরু হলো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অভিযাত্রা।

স্বাধীনতার পটভূমি আমাদের সবারই জানা আছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই একসময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধিকারের আন্দোলন একসময় স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল। কোন্দলপ্রবণ, দোদুল্যমান মানসিকতার এক জনগোষ্ঠী সেদিন যূথবদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতার এক দাবিতে, ভুলে গিয়েছিল সব দলাদলি, স্বার্থের ক্ষুদ্রতা; তারা রূপান্তরিত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধ এক জাতিতে, স্বাধীনতার মতো মহৎ এক অর্জনের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত। বাঙালির এই ঐক্যবদ্ধ বীরের জাতিতে রূপান্তরের কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি আমাদের জাতির পিতা।

আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজয় দিবসে বিশেষভাবে মনে করব স্বাধীনতার অভিযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশ যেসব রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যাদর্শের সন্ধান পেয়েছিল, সেগুলোর কথা। সেদিন দেশবাসী সংগ্রাম করেছিল গণতন্ত্রের জন্য; নেতৃত্ব উপলব্ধি করেছিল প্রকৃত গণতন্ত্র হবে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো অগ্রাধিকার থাকবে না। সব রকম শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য সেদিনের লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম। তবে পরবর্তীকালে বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজারের একচেটিয়া প্রতিপত্তির মধ্যে যে মিশ্র অর্থনীতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে যেন লুটেরা ধনিক গোষ্ঠী প্রাধান্য না পায়, সেটি নিশ্চিত করা ছিল জরুরি; যেন দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার ক্ষুণœনা হয়, তার জন্য প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আইনের শাসনের নিশ্চয়তাও হয়ে পড়ে আবশ্যিক। তা না হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, গণতন্ত্রকে কার্যকর ও বিকাশমান রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ রুদ্ধ হয়। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ আজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এক ক্রান্তিলগ্নে রয়েছে।

বাংলাদেশের গত ৫২ বছরের যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চক্রান্তের শিকার হয়েছে দেশ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতোই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রসমূহে উত্থানপতন ঘটেছে। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে। তবে এর মধ্যেও বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি ঘটেছে এবং গত ১৫ বছরে তা এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।

তবে রাজনৈতিক অর্জন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ও টেকসই করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি অর্জনের দায় সব রাজনৈতিক দল এবং সব ধরনের নাগরিক গোষ্ঠী ও সচেতন ব্যক্তির ওপর বর্তায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার পর দেশে বিভাজনের ও বিরুদ্ধতার চর্চা যতটা হয়েছে, ততটা হয়নি সমঝোতা ও সম্মিলনের। এতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম সৃষ্টির উপযোগী বাতাবরণ তৈরি বারবার ব্যাহত হয়েছে। অবশ্যই এটা প্রত্যাশিত ছিল যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে ইতিহাস এবং তার ফসল যেসব রাজনৈতিক দর্শন, তা-ই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। কিন্তু দেখা গেল রাজনৈতিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের আশু জরুরি চাহিদা পূরণের চাপে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জনমানসের রূপান্তর বা সামঞ্জস্য সাধনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো ধারার রাজনীতি জনগোষ্ঠীর একাংশের এই পশ্চাৎপদতাকে কাজে লাগিয়েছে। ক্ষমতার লড়াই যত জোরদার ও তাকে ঘিরেই রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে, ততই একাত্তরে ছেড়ে আসা চিন্তাধারার প্রত্যাবর্তনের গতি বেড়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এই ধারার সঙ্গে অন্যান্য ধারা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলধারা হিসেবে পরিচিত ধারাও নানাভাবে আপস করছে।

বিজয়ের এই দিনে চমকপ্রদ সব দর্শনীয় আধুনিক নির্মিতির সাফল্য কিংবা মানুষের গড় আয়, আয়ু, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হারসহ নানা সূচকের অতুলনীয় অগ্রগতির কৃতিত্ব দিয়েও বলতে দ্বিধা নেই যে মানুষ স্বস্তিতে নেই। এর কারণ:Ñ১. শাসনদণ্ড যাদের হাতে থাকছে, সেই রাজনৈতিক শক্তির সংঘাতময় অবস্থান। ২. রাজনীতিসহ সামগ্রিকভাবে চিন্তাজগতের অবক্ষয় ও স্থবিরতা। ৩. এ অবস্থায় সবক্ষেত্রেই উচ্চাভিলাষী সুযোগ-সন্ধানীদের প্রাধান্য বৃদ্ধি। তাদের দাপটে রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি, মূল্যবোধ থেকে রুচি সবক্ষেত্রে আপস শুরু হয়, এবং কোথাও কোনো বিষয়েরই মানদণ্ড স্থাপন সম্ভব হয় না। কথা হলো সমাজের এমন পরিণতি কি ঘটতে দেওয়া যায়? বলতে চাই, যায় না। তরুণ প্রজন্মের ওপর আশা রাখতে চাই।

তাই বলব, এবারের বিজয় দিবসে বিজয়ী জাতির প্রত্যাশা সুশাসন। তা নিশ্চিতের জন্য এখন প্রয়োজন শিক্ষায় মেগা প্রকল্প, গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ চিন্তাচর্চার সব প্রতিষ্ঠান ও স্থানের স্বাধীন অবস্থান। একাত্তরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেরি হলেও এখন অন্তত আর সময়ক্ষেপণ না করে গণতন্ত্রের উপযোগী নতুন সমাজগঠনের কাজ শুরু করতে হবে। একমাত্র সেভাবেই বিজয়ের প্রকৃত বারতা সমাজের গভীরে প্রবেশ করবে।

* আবুল মোমেন: লেখক ও সাংবাদিক, সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়।