‘আমার পুতুলের মতো ছেলেরে ছাইড়া কেমনে থাকমু’
ঘরজুড়ে আগরবাতির কড়া ঘ্রাণ, লোকে লোকারণ্য। এক কক্ষে রাখা শিশু ইয়াছিন আরাফাতের মরদেহ। পাশের ঘরেই সন্তানহারা নাসরিন আক্তারের আহাজারি। তিনি বলছিলেন, ‘আমার পুতুলের মতো ছেলেটা এভাবে চলে গেল। আমি কী নিয়া থাকমু, কেমনে ঘুমামু। তারে কেউ আইনা দাও। আমার মরণ কেন হইল না? আমার বাপধন কেন চইলা গেল?’
নাসরিনের পাশেই স্বামী মো. সাদ্দাম (২৫) তখন স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল। নিজেকে কোনোমতে সামলে ভাঙা স্বরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইয়াছিন আরাফাত ছিল আমার একমাত্র সন্তান। গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সে পৃথিবীতে এসেছিল। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু একটা ঝড় এসে সবকিছু উল্টে গেল।’
সাদ্দাম ও নাসরিন দম্পতির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর এলাকায়। কয়েক বছর আগে বিয়ে হয় তাঁদের। মাসখানেক আগে নাসরিন চট্টগ্রাম নগরের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়া এলাকায় তাঁর মায়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। সাদ্দাম ছিলেন আসা–যাওয়ার মধ্যে। গতকাল বিকেলে বাসার পাশে লাগোয়া নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় ইয়াছিন। প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর আজ সকালে নালার ওপর থাকা স্ল্যাবের নিচে আবর্জনার ভেতর থেকে দেড় বছরের শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
রঙ্গীপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি তিনতলা ভবনের নিচতলায় নাসরিনের মায়ের বাসা। সেখানে প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছিলেন ইয়াছিনকে একপলক দেখার জন্য। দেখা গেছে, ভবনের সামনেই সরু নালা। নালার ওপরে স্ল্যাব থাকলেও এক প্রান্তে স্ল্যাব নেই। ইয়াছিন হাঁটতে হাঁটতে সেই উন্মুক্ত অংশে গিয়ে পড়ে যায়।
‘ছেলেটারে কেন চোখে চোখে রাখলাম না’
গতকাল রোববারের পড়ন্ত বিকেল। ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটার ঘরে। সারা দিনের কাজ শেষে খেতে বসেছিলেন নাসরিন। অন্যরা যাঁর যাঁর মতো ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। হঠাৎ ইয়াছিন ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কেউ তা খেয়াল করেননি।
সেই আক্ষেপে বুক ফেটে যাচ্ছে সন্তানহারা এই মায়ের। কান্নায় গলার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘ছেলেটা বের হইতে আমি কেন দেখলাম না, কেন তারে চোখে চোখে রাখলাম না।’
ইয়াছিনের বাবা সাদ্দাম গতকাল নবীনগরে ছিলেন। তিনি পেশায় প্রাইভেট কারচালক। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে চেপে বসেন। সাদ্দাম বলেন, ‘নবীনগর থেকে আসার পথে বাসে আমি বসতেই পারছিলাম না। রাস্তা যেন শেষই হচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল কখন রাস্তা শেষ হবে। রাতে এসে এখানে-ওখানে খুঁজি। পুরো নালা তন্ন তন্ন করি। কিন্তু ছেলেকে পাইনি।’
ইয়াছিনের দাফন সম্পন্ন
দুপুর ১২টার দিকে বাসা থেকে ইয়াছিনের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় রঙ্গীপাড়ার একটি কবরস্থানে। সেখানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।
দাফনে নেমেছিল মানুষেল ঢল। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দা পিয়ার মোহাম্মদ ও এ কে এম নুরুদ্দিন অনেকটা অভিযোগের সুরেই প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার নালা-নর্দমাগুলো ময়লা–আবর্জনায় ঠাসা। এগুলো পরিষ্কার করা হয় না। এ কারণে হালকা বৃষ্টিতেই পানি উঠে আসে সড়কে। তখন কোনটা নালা, কোনটা সড়ক, তা বোঝা যায় না। নালা পরিষ্কার থাকলে ইয়াছিনকে গত রাতেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত।
এদিকে ইয়াছিনের মৃত্যুর পর নালা পরিষ্কার করা হয়েছে। আজও নালা থেকে আবর্জনা তোলার কাজ করছিলেন শ্রমিকেরা।