আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতন্ত্র থেকে বের হতে পারিনি: ইফতেখারুজ্জামান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘আশা ছিল যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের আদিবাসী মানুষেরা আরও বেশি অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু আমরা সেদিকে যেতে পারিনি। সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশের স্বপ্ন বিনির্মাণ করা যায়নি। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতন্ত্র থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি।’
মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ে এক কর্মশালায় এ কথা বলেন ইফতেখারুজ্জামান। আজ রোববার রাজধানীর আসাদগেটের ওয়াইডব্লিউসিএ ভবনে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
ইফতেখারুজ্জামান আজকের কর্মশালায় বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন, প্রধান উপদেষ্টার ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার প্রভৃতি অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময়ের পরও ওই কার্যালয়ের কোনো সুফল জনসাধারণ পেয়েছে কি না, তা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, রাষ্ট্র আদিবাসী শব্দটি বলতে চায় না। কেননা আদিবাসী বললে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষা করতে হবে। যদি সংবিধানে আদিবাসী স্বীকৃতি এবং আইএলও ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করা হয়, তবু আদিবাসীদের অধিকার অর্জিত হবে না। কারণ, আদিবাসী স্বীকৃতি দিলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত আসবে।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, কোনো জনগোষ্ঠীকে যুগ যুগ ধরে নির্যাতন চালিয়ে, শাসন করে দমিয়ে রাখা যায় না। পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসী মানুষের অধিকারের আন্দোলন দেশের সমগ্র মানুষের আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
কর্মশালায় ফ্রান্স দূতাবাসের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স কো-অপারেশন বিভাগের এমিলি পালাউন বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। তারা তাদের ভূমি, সংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার রক্ষা করতে গিয়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূমি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষভাবে সমস্যার শিকার আদিবাসী নারীরা।
কাপেং ফাউন্ডেশনের অ্যাডভোকেসি অফিসার হ্লা¤রাচিং চৌধুরীর সঞ্চালনায় কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারপারসন গৌরাঙ্গ পাত্র।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, কাপেং ফাউন্ডেশন প্রতিবছর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর এ ধরনের কর্মশালার আয়োজন করে থাকে।
বেসরকারি সংগঠন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এ সময়ে অধিকারের প্রশ্নে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মানবাধিকার, ভূমি অধিকার, নারীর ওপর সহিংসতা, হত্যার মতো অনেক ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে আসছে না। ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণের পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয়ভাবে উত্ত্যক্ত করা, তাদের বিশ্বাসে আঘাত করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি বিভাগের পরিচালক জনা গোস্বামী বলেন, সমতলের আদিবাসীরা এখনো সুসংগঠিত নয়। প্রতিনিয়তই তারা নিপীড়ন–নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে বাস্তুভিটা হারাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে।
সভাপতির বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন গৌরাঙ্গ পাত্র বলেন, চব্বিশের যে বহুত্ববাদের স্বপ্ন, সেটি এখন মৌলবাদীদের হাতে চলে যাচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো ঘটনাগুলো এখন প্রতিনিয়ত হচ্ছে। সবাই ভালো ভালো কথা বললেও মাঠের কার্যক্রমে সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যায় না।
মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনটির প্রজেক্ট অফিসার ত্রিজিনাদ চাকমা। মূল বক্তব্যে তিনি বলেন, কাপেং ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ওপর মোট ৯৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ভূমিকেন্দ্রিক ঘটনা ঘটেছে ১৮টি, যার মধ্যে সমতলে ৪টি ও পাহাড়ে ১৪টি এবং মোট ১ হাজার ৭ জন এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন। অপরদিকে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই ২০২৫ রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫টি ভূমিকেন্দ্রিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ৩৪টি রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার–সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যেখানে মোট ৩৬৮ জন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
কর্মশালা আরও বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক পার্থ শঙ্কর সাহা। অনুষ্ঠানে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, জয়েনশাহি আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের ইউজিন নকরেক, কুবরাজ ইন্টার-পুঞ্জি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলি তালাং, সিএইচটি জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সন্তশিতো চাকমা বকুল, নমিতা চাকমা প্রমুখ।