নির্বাচনী ইশতেহারে আসুক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী

নির্বাচন আসে, সেখানে ইশতেহারেও থাকে নানান প্রতিশ্রুতি; কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই প্রশ্ন থেকে যায়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে নানা কথা থাকলেও তাদের অধিকারের অনেক বিষয়ই মীমাংসিত না। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে রাজনীতির মূলধারায় প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসতে হবে।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ক্রিশ্চিয়ান এইড ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার’ শীর্ষক এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়।

আয়োজনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, রাষ্ট্রকে ভালো থাকার নির্ণায়ক হতে হবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভালো থাকা। ঐতিহাসিক অবিচারব্যবস্থার কারণে এই জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী তাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য জাতীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য সুরক্ষা আইন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার আগে এসব মানুষ স্বাধীনভাবে যেন সম্মতি দিতে পারেন।

ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবিন বলেন, দেশে এখনো অনেক আইন আছে, যেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে না। এই জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সামনে আনা যায়, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যেন আসে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলো দেখতে হবে এবং আলোচনা বারবার চালিয়ে যেতে হবে।

গোলটেবিলে ধারণাপত্র পাঠ করেন ক্রিশ্চিয়ান এইডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহেনুর আলম চৌধুরী। তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দাবিগুলো তুলে ধরেন। দাবির মধ্যে রয়েছে, বিভিন্ন আইন ও নীতিতে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা, পর্যাপ্ত বাজেট, হিজড়া ও রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য দণ্ডবিধি ১৮৬০ সংশোধন ও উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি লাভের অধিকার, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন নীতিতে সংশোধন আনা, বৈষম্য বিরোধ আইন পাস করা এবং সংখ্যালঘু কমিশন ও ভূমি কমিশন গঠন করা।

দলিত-বঞ্চিত অধিকার আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক তামান্না সিং বড়াইক বলেন, দলিত জনগোষ্ঠী নিজেদের অধিকার সম্পর্কেই জানে না। তারা দেশের জন্য কাজ করে; কিন্তু সমাজে সম্মানজনক স্বীকৃতি নেই। বৈষম্যবিরোধী আইন, বেতন–ভাতাসহ সব ক্ষেত্রে স্বীকৃতির দাবি জানান তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এস এম মাসুম বিল্লাহ বলেন, গ্রাম ও মানুষকেন্দ্রিক চিন্তা রাজনীতিকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র বললে দেশের সব মানুষকেই বোঝায়। গৃহহীন মানুষকে ঘর দেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের ভূমি অধিকার সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। সেখানেও মনোযোগ দিতে হবে। প্রান্তিক মানুষের কথা রাজনীতিতে আনতে হবে।

অধিকারের প্রশ্নে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেমন, সেটা দেখার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল বক্তব্যে যদি এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের না আনা যায়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব না। তিনি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করার কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক সানজিদা আখতার বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর অধিকারকে প্রাধান্য দিতেই হবে। সম্মানজনক কাজের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের জন্য যদি প্রান্তিক অবস্থানেই রাখা হয় সেটা কাজে আসবে না। তাদের সুন্দর জীবনযাপনে সহায়তা করতে পারে এমন কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রাখতে হবে।

প্রান্তিক অবস্থায় যেসব মানুষ রয়েছেন তাঁরা পিছিয়ে থাকেননি, তাঁদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা। তিনি বলেন, সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কাজে একদিকে যেমন কিছু মানুষ সুবিধাভোগী হচ্ছেন, তেমনি আরেক দিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্র কারও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নেয় না। ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে নিজের জায়গা করে নেয়।

সম্পর্কের নয়া সেতু সংগঠনের সভাপতি জয়া শিকদার বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে রাষ্ট্রের এখনো অনেক কিছু জানার বাকি আছে। সংসদে হিজড়া, রূপান্তরিত নারী ও রূপান্তরিত পুরুষের জন্য আলাদা সংরক্ষিত আসনের দাবি জানান তিনি। ভোটার আইডি তৈরিতে তাঁদের জন্য এখনো জটিলতা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক এলাকাগুলোর জেলা প্রশাসনে আলাদা ব্যবস্থা রাখা, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা–ব্যবস্থাসহ ট্রান্সজেন্ডারদের বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা করার কথা বলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তাজুল ইসলাম।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী ওয়াসিউর রহমান বলেন, সরকার স্মার্ট দেশ গড়ার কথা বলছে, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো অনেক মানুষ আছেন যাঁরা ডিজিটাল সেবার বাইরে রয়েছেন। এসব মানুষের কথা ভেবে নীতি করতে হবে।

গোলটেবিলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ক্রিশ্চিয়ান এইডের জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন প্রোগাম ম্যানেজার আঞ্জুম নাহীদ চৌধুরী।

এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগের প্রকল্প সমন্বয়ক ইশতিয়াক মাহমুদ, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রকল্প সমন্বয়ক মুন্ডা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি উইলিয়াম তপ্নো ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়ক অনিরুদ্ধ রায়।

অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। গোলটেবিলটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।