লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ২৬ ঘণ্টা

একাত্তরের মার্চ থেকে বাহাত্তরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটনাবহুল পর্ব নিয়ে মহিউদ্দিন আহমদের লেখা বই একাত্তরের মুজিব সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে। এ বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার, বন্দিজীবন, মুক্তি ও দেশে ফিরে আসার আখ্যান উঠে এসেছে। পাকিস্তানে সাড়ে নয় মাসের বন্দিজীবন শেষে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছান। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ২৬ ঘণ্টা অবস্থানের বিবরণ পাওয়া যায় বাংলাদেশি কূটনীতিক রেজাউল করিমের ভাষ্যে। আজ ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বইটি থেকে রেজাউল করিমের ভাষ্যটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২
ছবি: একাত্তরের মুজিব বই থেকে

৮ জানুয়ারি ১৯৭২, ইসলামাবাদে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার জন পামফ্রে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন। সকাল সোয়া ৭টায় এবং দ্বিতীয়বার সকাল সোয়া ৮টায় তাঁর বাসায় ফোন আসে। সেই ফোনকলে জানানো হয়, তিনি যেন সকাল ৯টার ভেতর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে আসেন। তাঁকে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয়, তিনি যেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জরুরিভাবে জানান। জন পামফ্রে বার্তাটি পড়ে ইসলামাবাদ সময় সকাল সোয়া ৯টায় লন্ডনে ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসে (এফসিও) একটি টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটি ছিল এ রকম:

ইসলামাবাদ থেকে ৩৮০৪২০জেড

অশ্রেণিবদ্ধ

জরুরি এফসিও টেলি নং ৮৬, ৮ জানুয়ারি

মুজিব হিথরো আসছেন, বিশেষ পিআইএ বিমান ০৫৩০জেড, ৮ জানুয়ারি

২. তাঁর হয়ে পাকিস্তান সরকার জানাচ্ছে:

(ক) বিমানে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সরাসরি ভিআইপি কক্ষে নেওয়া যেতে পারে। গাড়ি পাওয়া গেলে তাঁকে তাঁর ইচ্ছামাফিক স্থানে নিয়ে যেতে হবে।

(খ) তিনি মুখ খোলার আগে এটা প্রচার করা যাবে না।

তারবার্তাটি ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের হাতে আসে। লন্ডনে তখন দিবাগত রাত ৩টা। সাদারল্যান্ড যখন হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান, তখন বেশ ভোর।

সকাল সাড়ে ৬টায় পিআইএর বিশেষ বিমানটি নামে। সাদারল্যান্ড ড. কামাল হোসেনকে লন্ডনে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মিশনপ্রধান এম এম রেজাউল করিমের ফোন নম্বর দেন। কামাল হোসেন ফোন করে রেজাউল করিমের ঘুম ভাঙান এবং তাঁকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেন।

রেজাউল করিম ফোন করেন লন্ডন মিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদকে। তিনি মহিউদ্দিনকে বলেন বিমানবন্দরে যেতে। ওই সময় নাইজেরিয়ার পাকিস্তান দূতাবাস থেকে পক্ষ ত্যাগ করে তৃতীয় সচিব মহিউদ্দিন জায়গীরদার লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তিনিও বিমানবন্দরে যেতে চাইলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রেজাউল করিম, মহিউদ্দিন আহমদ ও মহিউদ্দিন জায়গীরদার ছুটলেন হিথরো বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাতে।

শেখ মুজিব লন্ডনে ছিলেন ২৬ ঘণ্টা। কাটিয়েছেন কর্মব্যস্ত সময়। ওই সময়ের একটি বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন রেজাউল করিম। এখানে তা উল্লেখ করা হলো তাঁর ভাষ্যে।

রেজাউল করিমের ভাষ্য

‘রেজাই করিম, শেখ মুজিব বলছি’—গভীর, অতিপরিচিত ও অতি আকাঙ্ক্ষিত স্বর ভেসে এল টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে। সময় ছিল ভোর প্রায় ৫টা, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি এবং স্থান লন্ডন।

আমি বাক্যহীন, শিহরিত। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কথা না বলতে পেরে বিমূঢ় হয়ে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। বাংলাদেশের জনগণের হারিয়ে যাওয়া নেতা, যাঁকে সুদীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর মুখোমুখি থাকতে হয়েছে, যাঁর মুক্তির জন্য আমরা বিশ্বব্যাপী সর্বক্ষণ সর্বপ্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছি, তিনি আজ মুক্ত, স্বাধীন মাটিতে সশরীর এসে পৌঁছেছেন লন্ডনে। এই সুসংবাদ বিশ্বাস করাই মুশকিল।

‘আপনি কেমন আছেন, আপনার শরীর কেমন?’—আমার তাৎক্ষণিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্ন। ‘আমি আছি কোনো রকম। তোমরা সকলে কেমন আছো?’ ক্লান্ত স্বরে এল জবাব। একটু স্বস্তির রেশ ছিল বলে মনে হয়।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমার বাসার টেলিফোন নম্বর দেওয়ায় ড. কামাল হোসেন আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে মিলিয়ে দিলেন। ড. কামাল হোসেনও সপরিবার একই বিমানে পাকিস্তান থেকে এলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিদেশস্থ বিশেষ প্রতিনিধি এবং লন্ডনের বেসরকারি বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে আমিই তখন দূতাবাসের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে কর্মরত। আমি আমার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ওঠালাম।

শুনে তিনি বিহ্বল হয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বললাম, তিনি যেন সঙ্গে সঙ্গেই আমার সহকর্মীদের টেলিফোনে যোগাযোগ করে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অধুনালুপ্ত আলকক অ্যান্ড ব্রাউন ভিআইপি স্যুইটে আসার চেষ্টা করতে বলেন।

বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আমি যত দূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য এমন বেগে গাড়ি চালিয়েছি যে, জীবনে এত বেগে কখনো গাড়ি চালাইনি। গাড়িতেই শুনলাম রেডিওতে বলছে, শেখ মুজিব মুক্ত হয়েছেন এবং এক অজ্ঞাত গন্তব্যস্থলের লক্ষ্যে বিমানযোগে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন। তিনি তখন সারা বিশ্বে শেখ মুজিব বলেই পরিচিত ছিলেন। আসতে আসতে আমার মনে বেশ কিছু চিন্তার উদয় হলো। তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কেমন, মুক্তিযুদ্ধের ও বিজয়ের বিষয়ে তিনি কতটুকু জানেন, নতুন স্বাধীন দেশের দিকনির্দেশনা ও পরিচালনা তিনি কীভাবে করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি ভিআইপি লাউঞ্জে ঢোকামাত্রই প্রথম কামরাতে বসা কয়েকজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে স্যালুট করে কোনো কথা না বলেই তাঁরা কামরা থেকে চলে গেলেন। পরে শুনলাম, তাঁদের মধ্যে পিআইএর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল জাফর চৌধুরীও ছিলেন। তাঁরা পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা বিশেষ ব্যক্তিকে কোনো দায়িত্ববান বাংলাদেশির কাছে সোপর্দ করেই তাঁদের কর্তব্য শেষ করলেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে তখনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেখানে পৌঁছাননি। আমি ঝড়ের বেগে কামরায় ঢুকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম, এবং আস্তে আস্তে তাঁর দিকে অগ্রসর হলাম।

বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ছিলেন। সফরে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, যথারীতি তাঁর হাতে ছিল প্রিয় পাইপ। স্বাস্থ্যবান, যদিও কিছু শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মানসিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, দেখেই যেন তা-ই মনে হলো। হাসিমুখে দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর বাহুবেষ্টনে কতক্ষণ ছিলাম, মনে নেই। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, তোমাকে স্বাগত জানাই। ঠিক করে বলতে পারলাম কি না মনে নেই, যদিও এই কথাগুলো বলার জন্য আসার পথে কয়েকবার রপ্ত করে নিয়েছিলাম। দুজনেরই চোখ দিয়ে তখন বয়ে এসেছিল আনন্দাশ্রু। ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী পাশে বসে ছিলেন, এই ভাবগম্ভীর দৃশ্যটা দেখছিলেন।

‘সত্যিই আমরা স্বাধীন হয়েছি?’ অল্পক্ষণের মধ্যেই সংযত হয়ে প্রশ্ন করলেন বঙ্গবন্ধু। বেশ আবেগের সঙ্গেই। তাঁর প্রশ্নটা ছিল আনন্দের ও কিছুটা অবিশ্বাসের এক সংমিশ্রণ। ‘জি হ্যাঁ, সত্যিই, সত্যিই’—আমি তাঁকে জোরালোভাবে আশ্বস্ত করলাম। তিনি বসলেন, তাঁর পাইপে একটা সুখটান দিলেন। খুশি মন ছিল তাঁর, যদিও এক ক্ষণস্থায়ী চিন্তার রেশ পাওয়া গেল তাঁর মুখে।

আমরা কথা বলছিলাম। বেশ কিছু কথা হলো বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজনের, সহকর্মীদের, দেশের পরিস্থিতির ওপর—যদিও সংক্ষেপে। কারণ, সত্ত্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড কামরায় ঢুকলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানালেন এবং লন্ডনে তাঁর অবস্থান সুখময় করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

যেহেতু ব্রিটিশ সরকার তখনো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, সেহেতু এবং তাঁর এত স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধুকে যথাযথভাবে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার দেওয়া সম্ভব হয়নি। ইয়ানের সঙ্গে আগে থেকেই আমার কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভালো পরিচয় ছিল। পরে, স্যার ইয়ান ও আমি মস্কোতে নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলাম।

প্রথম বিবেচ্য বিষয়টি ছিল, বঙ্গবন্ধু কোথায় থাকবেন। তিনি বলেন, কেন, দুবছর আগে যেখানে ছিলাম, সেই হোটেলটা এমন কিছু খারাপ ছিল না। আমার স্মরণ ছিল, ওটা রাসেল স্কয়ারের প্রেসিডেন্ট হোটেল, যেখানে সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা থাকে। আমি বললাম, ওটা ঠিক হবে না এবং সাদারল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনার পর বললাম, যে হোটেলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী থেকেছেন, সেই ক্ল্যারিজেসেই আপনি থাকবেন। ‘সে তো অনেক খরচ, এত পয়সা পাবি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।

জীবনের প্রথম ও আশা করি শেষবারের মতো আমি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ বা হুমকি অমান্য করলাম। সম্ভ্রমসহকারে বললাম, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আপনাকে যথোপযুক্ত হোটেলে রাখার দায়িত্ব আমাদের। তিনি স্নেহভরে তাকিয়ে হাসলেন। বুঝলাম, তিনি তাঁর এক কর্মকর্তার গুরুতর অপরাধ-আদেশ অমান্য করা-ক্ষমা করলেন। সাদারল্যান্ড টেলিফোনে হোটেল বুকিং সেরে ফেললেন।

এরপরে এল যাত্রার পালা। ব্রিটিশ সরকার বিরাট এক লিমুজিন মোটরগাড়ির ব্যবস্থা করল বঙ্গবন্ধুকে হোটেলে নিয়ে যেতে। ভেতরে ঢোকার সময় বঙ্গবন্ধু ইঙ্গিত করলেন আমাকে অপর পাশে বসতে। আমি ইতস্তত করলাম। বললাম, আমি পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর সব কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আপনার সঙ্গে চলে গেলেই আমার একমাত্র সম্পত্তি, গাড়িটি ট্রাফিক পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে চলে যাবে। অনেক দিন ও অনেক খরচ লাগবে এটাকে উদ্ধার করতে। এই বলে আমি আমার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম। গাড়ি চলতে শুরু করার আগেই দেখলাম কে একজন দরজা খুলে আমার পাশে বসলেন, বঙ্গবন্ধু! তিনি বললেন, ‘তোর গাড়িতেই যাব।’ কোনোরকমেই তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত করতে সক্ষম হলাম না। ড. কামাল হোসেন তাঁর পরিবারবর্গ ও আমার সহকর্মীসহকারে সরকারি গাড়িতে আমার পেছনে পথ অনুসরণ করে আসতে লাগলেন।

আমার ফোর্ড কর্টিনা গাড়িতে আমার পাশে বসে তিনি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন গত ৯ মাসের ঘটনাবলি সম্বন্ধে। এক এক করে যতটুকু মনে পড়ল, বললাম। স্বভাবতই এটা ছিল তাঁর প্রথম ব্রিফিং। কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার মনে একটা দারুণ চিন্তার উদয় হলো। চিন্তা করে গুছিয়ে কথা বলছিলাম আর গাড়ি চালাচ্ছিলাম, হাত কিছু কাঁপছিল। যদি এই সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে কী হবে? লোকে বলবে, ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো ৯ মাসেও যা শেখ মুজিবকে করতে পারেনি, রেজাউল করিম আধা ঘণ্টায় সহজেই সে কুকাজটা করে ফেলল। শরীরের মধ্য দিয়ে এক শিহরণ বয়ে গেল।

ক্ল্যারিজেসে পৌঁছানোর পর অগণিত দর্শনার্থী, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও হাজারো বাঙালি হোটেলে ভিড় জমাল বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। দূতাবাসের সব কষ্টসহিষ্ণু ও নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীর সহযোগিতায় আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি করতে সক্ষম হলাম। আমরা তখন সবাই মিলে প্রায় ১৬ জন। আমি প্রথম টেলিফোনে বেগম মুজিব, পরিবারের অন্যদের ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। এর পরেই করলাম শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে।

আমরা বাংলাদেশিদের পাঁচজনের একেকটি দলে ভাগ করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে দিলাম। পাঁচ মিনিট করে সময় দেওয়া হলো প্রায় সব ক্ষেত্রে। তাঁর নিরাপত্তা ও বিশ্রামের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলো। যেসব গণ্যমান্য ব্যক্তি হোটেলে দেখা করতে এলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন, কমনওয়েলথের মহাসচিব আরনল্ড স্মিথ, সাবেক মন্ত্রী পিটার শোরসহ বহু সংসদ সদস্য ও অন্যরা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে চেকার্সে গিয়েছেন। তিনি সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে লন্ডনে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে—সুদূর কানাডা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতিনিধিরা জড়ো হলেন ক্ল্যারিজেসে। সবাই চান একান্ত সাক্ষাৎকারের অনুমতি। কয়েকজনকে দিলে অন্যরা অসন্তুষ্ট হবেন। তাই ঠিক হলো, একটি সংবাদ সম্মেলন করা হবে। বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান বন্ধুবর সিরাজুর রহমান ও প্রখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব ডেভিড ফ্রস্ট খুশি হলেন না। পরে ঠিক করলাম, তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু সম্মান প্রদর্শনের জন্য কয়েক মিনিট দেখা করবেন।

তার মধ্যেই ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জোগাড় করে নিলেন। খুব তাড়াতাড়ি করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম রাষ্ট্রপতির প্রথম সরকারি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করলাম। ড. কামাল হোসেন সেটাকে আরও সুন্দর করলেন। সাংবাদিকদের সম্ভাব্য প্রশ্নসংবলিত একটা তালিকাও বঙ্গবন্ধুকে পড়ে শোনালাম। শুনলেন, হেসে বললেন, জবাবগুলো তোমার বলা লাগবে না। ইতিমধ্যেই জেনে গেছি।

ক্ল্যারিজেসের বিরাট বলরুম লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের অবস্থানে। পাশের কামরাতেও লোক দাঁড়িয়ে। আমি সামান্য একটু আনুষ্ঠানিকতা পালন করলাম বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য দেওয়ার আগে তাঁর সম্বন্ধে দুটো কথা বলে। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার ছিল না। তাঁর নাম বিশ্বের সব প্রান্তে। সবাই অধীর আগ্রহে নতুন জাতির নতুন নেতার বক্তব্য শুনলেন। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ২৬ ঘণ্টার অবস্থান খুব সহজে ও অল্পতে বলা যায় না। এই সময়ে আমাকে তাঁর ছায়ার মতো সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। ঘটনাগুলোর কিছু বিবরণ এখন দেওয়া হলো। বক্তৃতা ও অন্য আলোচনার বিষয়গুলো রয়েই গেল।

ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা সরকারি বিমানের ব্যবস্থা করল। সাইপ্রাসে তেল নিয়ে এটা দিল্লি হয়ে ঢাকায় যাবে। তিনি বললেন, আমাকে তাঁর সঙ্গে ঢাকায় যেতে হবে। পরে মত পরিবর্তন হলো। কারণ, হাজার হাজার বাংলাদেশি, যাঁরা পরের দিন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য আসবেন, তাঁদের বুঝিয়ে বলার জন্য আমার লন্ডনে থাকা প্রয়োজন ছিল।

বঙ্গবন্ধুর ফিরে যাওয়ার দিনক্ষণ গোপন রাখা হয়েছিল নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এমনকি আমার সহকর্মীদেরও বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রায় ভোর পাঁচটার সময় অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযাত্রীদের হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে নিয়ে গেলাম বিমানবন্দরে। ব্রিটিশ সরকারের কমেট বিমানটি তাঁদের সবাইকে নিয়ে যখন উড়ল, তখন বাজে প্রায় সকাল সাতটা। শুধু ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান স্যার ডেনিস গ্রিনহিল ও আমি হাত নেড়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাই হিথরোর টারমাকের ওপর দাঁড়িয়ে।­­­

তথ্যসূত্র

১. সুজাত, তারিক (২০২২), বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: কমেট বিমান ও ব্রিটিশ গোপন দলিল, জার্নিম্যান, ঢাকা, পৃ. ১৫৬

২. ওই, পৃ. ২১৫

৩. করিম, এম এম রেজাউল (২০০৫), কূটনীতিকের অভিজ্ঞতা, ইরা প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ১২

৪. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০২০), আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১, প্রথমা, ঢাকা, পৃ. ১৫৬

৫. করিম, পৃ. ১২-১৬