সৌদি যেতে বাড়তি খরচের বোঝা 

দক্ষতা যাচাই পরীক্ষার জন্য কর্মীদের নিবন্ধন ফি দিচ্ছেন না সৌদি নিয়োগকর্তারা। এতে ডলার–সংকটের মধ্যেই বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। 

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে দক্ষতা যাচাই কর্মসূচি চালু করেছে সৌদি আরব সরকার। অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে এ সনদ নিতে হয় কর্মীদের। এর জন্য ৫০ ডলার নিবন্ধন ফি সৌদি নিয়োগকর্তার পরিশোধ করার কথা। যদিও এটি পরিশোধ করছেন সৌদি গমনেচ্ছু কর্মীরা। এর জন্য বিভিন্ন দালাল ও কম্পিউটার দোকানের মাধ্যমে তাঁরা খরচ করছেন সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। 

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, সৌদি আরবে গিয়ে কর্মীদের নিয়মিত প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ আছে। যে কাজের কথা বলে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়, সেই কাজ পান না অনেকে। আবার অনেকে কাজ না শিখেই দালালের মাধ্যমে দেশটিতে চলে যান। দক্ষতা সনদ নিয়ে গেলে কাজের সুবিধা হবে। এ ক্ষেত্রে বেতনও প্রায় দ্বিগুণ হবে কর্মীর। 

পরীক্ষার জন্য কর্মী কেন ফি দেবেন? এতে তো অনেক ডলার বিদেশে চলে যাবে। এ ছাড়া এখনই এমন সনদ বাধ্যতামূলক করা ঠিক হয়নি। সব খাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, প্রস্তুতি নিয়ে পর্যায়ক্রমে এটি চালু করা যেতে পারে। না হলে সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো কমে যেতে পারে। 
এম টিপু সুলতান, যুগ্ম মহাসচিব, বায়রা

দক্ষতা যাচাই কর্মসূচি চালু করার আগে সৌদির সরকার অনুমোদিত দেশটির সংস্থা তাকামল ও বিএমইটির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করে ঢাকার সৌদি দূতাবাস। এ সময় বলা হয়, নিবন্ধন পরীক্ষার জন্য কর্মীদের টাকা দিতে হবে না। ৫০ ডলারের বিষয়টি দেখবে তাকামল। একজন একাধিকবার পরীক্ষা দিতে পারবেন। পরীক্ষার সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। শুরুতে পাঁচটি খাতে দক্ষতা পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক করে সৌদি সরকার। এর সঙ্গে গত মাস থেকে যুক্ত হয়েছে আরও ২৮টি খাত। এখন থেকে মোট ৩৩টি খাতে সনদ নিয়ে যেতে হবে। এ পরীক্ষার জন্য অনলাইনে ৫০ ডলার ফি পরিশোধ করে নিবন্ধন করতে হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা ও টাঙ্গাইলের ছয়টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এ পরীক্ষা নিচ্ছে এখন।

বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করেই এটি কার্যকর হয়েছে। বিএমইটি পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারেনি। তাই প্রস্তুতির সময় দিতে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আর কর্মসূচি চালুর সময় নিবন্ধন ফির বিষয়ে যা বলা হয়েছে, সেটাই হবে বলে প্রত্যাশা বিএমইটির। এতে কোনো ব্যত্যয় হয়েছে কি না, তা দেখতে এবং তাকামলের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের জন্য অতিরিক্ত মহাপরিচালককে (প্রশিক্ষণ) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

পরীক্ষা কেন্দ্র দেখতে ২২ আগস্ট সকালে ঢাকার দারুস সালাম এলাকায় বাংলাদেশ–কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিকেটিটিসি) যান এই প্রতিবেদক। এ সময় লিখিত পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষমাণ ছয়জনের সঙ্গে কথা হয়। সবাই এসেছেন ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে পরীক্ষা দিতে। তাঁরা বলেন, নিবন্ধন ফি ৫০ ডলার অনলাইনে পরিশোধ করতে হয়। তাঁদের পক্ষে এটি করা সম্ভব নয়। বিকেটিটিসি চত্বরে কিছু দালাল আছেন, যাঁরা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দাবি করেন। কেউ কেউ দালালের মাধ্যমে করেন। তাঁরা বিকেটিটিসির পাশের গলিতে থাকা কম্পিউটারের দোকান থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা পরিশোধ করে পরীক্ষার নিবন্ধন করেছেন।

সৌদি আরবে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন
ছবি: এএফপি

বিকেটিটিসির অধ্যক্ষ মো. লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দালাল প্রতিরোধে এ কেন্দ্রের সব ধরনের ভর্তি অনলাইনে করা হয়েছে। আর সৌদির জন্য দক্ষতা পরীক্ষার সঙ্গে তাঁদের কোনো লেনদেনের বিষয় নেই। যাঁরা এ কেন্দ্রের নিবন্ধনপত্র নিয়ে আসেন, তাঁদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। 

বিকেটিটিসি বলছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে নিবন্ধিতদের পরীক্ষা শুরু হয়েছে এখানে। প্রথমে পাঁচটি ক্যাটাগরির জন্য পরীক্ষা নেওয়া হতো। গত মাস থেকে ১০টি খাতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এতে চাপ বেড়েছে। তাই প্রতিদিনই পরীক্ষা নেওয়া হয় নিবন্ধিতদের। ২২ আগস্ট পর্যন্ত এ কেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করেছেন ২ হাজার ৫০৬ জন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন নিবন্ধন আবেদন বাতিল করেছেন। ১ হাজার ৬৪৮ জনের মধ্যে ৩১৭ জন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন।

পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে কথা হয় ২৫ বছরের এক তরুণের সঙ্গে। তিনি বলেন, টাইলসমিস্ত্রি হিসেবে সৌদি আরবে যাওয়ার নিয়োগপত্র নিয়েছেন। টাইলসের কাজ নিয়ে তাঁর ধারণা নেই। ঢাকার একটি গাড়ির গ্যারেজে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন। তাই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির খোঁজ নিতে এসেছেন। কীভাবে কৃতকার্য হওয়া যায়, তার পথ খুঁজছেন।

তবে পরীক্ষাপ্রক্রিয়া নিয়ে লুৎফর রহমান বলেন, লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে ওই দিনই ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হয় ই–মেইলে। বিষয়ভিত্তিক খুবই সাধারণ মানের প্রশ্ন করা হয়। কারও যদি ওই কাজের সম্পর্কে ধারণা না থাকে, তাহলে অকৃতকার্য হন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯ শতাংশ অকৃতকার্য হয়েছে এ কেন্দ্রে।

পরীক্ষা কেন্দ্র দেখতে ২২ আগস্ট সকালে ঢাকার দারুস সালাম এলাকায় বাংলাদেশ–কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিকেটিটিসি) যান এই প্রতিবেদক। এ সময় লিখিত পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষমাণ ছয়জনের সঙ্গে কথা হয়। সবাই এসেছেন ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে পরীক্ষা দিতে। তাঁরা বলেন, নিবন্ধন ফি ৫০ ডলার অনলাইনে পরিশোধ করতে হয়।

প্রথমে প্লাম্বার, ওয়েল্ডিং, অটোমোবাইল, ইলেকট্রিশিয়ান ও এসি মেকানিক খাতে দক্ষতা সনদ চালু করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১৫ ধরনের নির্মাণকাজ, পাঁচ ধরনের টাইলিং, চার ধরনের গাড়ি মেরামত, প্লাস্টার কাজ ও তিন ধরনের মেকানিক। দক্ষতা যাচাই কর্মসূচি উদ্বোধনের সময় ঢাকার সৌদি দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়, অদক্ষ কর্মীরা যদি ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ রিয়াল পায়, দক্ষ কর্মীরা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ রিয়াল পাবে। 

এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈশা ইউসেফ ঈশা আল-দুহাইলানের কাছে লিখিত প্রশ্ন করে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু রাত ৯টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। 

বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত তিনটি রিক্রুটিং এজেন্সি, বিএমইটি ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই অভিবাসন খরচ অন্য দেশের তুলনায় এখানে কয়েক গুণ। এখন আবার কর্মীদের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি মাসে এক হাজার কর্মী পরীক্ষার জন্য নিবন্ধন করলেই ৫০ হাজার ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশের ডলার–সংকটের মধ্যে এটিও একটি চাপ তৈরি করবে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় গন্তব্য সৌদি আরব। গত বছরও দেশটিতে গেছেন ৬ লাখের বেশি কর্মী।

গত ২৫ জুলাই সৌদি আরবের পক্ষ থেকে সনদ বাধ্যতামূলকের বিষয়টি জানানো হয়। এটি ওই দিন থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। এতে অনেকগুলো বিষয় পরিষ্কার হয়নি। যথাযথ প্রস্তুতিও নেওয়া যায়নি। তাই কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এ কর্মসূচি স্থগিত করার দাবি জানিয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)। এর আগে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় চেয়ে বিএমইটি চিঠি দিয়েছে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে। এরপর এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। 

বায়রার যুগ্ম মহাসচিব এম টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষার জন্য কর্মী কেন ফি দেবেন? এতে তো অনেক ডলার বিদেশে চলে যাবে। এ ছাড়া এখনই এমন সনদ বাধ্যতামূলক করা ঠিক হয়নি। সব খাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, প্রস্তুতি নিয়ে পর্যায়ক্রমে এটি চালু করা যেতে পারে। না হলে সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো কমে যেতে পারে।