জয়ের নেশায় ঘোড়া ছোটানো তাসমিনার স্বপ্ন পুলিশ হওয়া

প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘অধুনা’য় ২০১৫ সালের ১৭ জুন ‘এক দুঃখী ঘোড়সওয়ারের গল্প’ শিরোনামে তাসমিনার ঘোড়দৌড়ে জেতার গল্পটি ছাপা হয়। ওই বছর ঢাকার একজন ব্যবসায়ী তাসমিনাকে একটি ঘোড়া কিনে দেন। কিন্তু ঘোড়াটির এক চোখ ছিল অন্ধ। এরপরও থেমে থাকেননি তাসমিনা। কমেনি ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের নেশাও। এখন কেমন আছেন ২০১৫ সালের সেই তাসমিনা?

তাসমিনা

২০১৫ সালের জুন মাস। তাসমিনা পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। তখন তার নিজের ঘোড়া ছিল না। অন্যের ঘোড়া জিতিয়ে পুরস্কারটা মালিকের হাতে তুলে দিয়ে শুধু জয়ের আনন্দটা নিয়ে বাড়ি ফিরত। এখন নিজের ঘোড়া হয়েছে। তাসমিনাও আর ছোট্টটি নেই। শুধু নিজের এলাকায়ই খেলে না, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যায়। কিন্তু দূর–দূরান্তে ঘোড়া পরিবহনের যে খরচ—তা পুরস্কারের অর্থমূল্যে পোষায় না। তাই দূরের খেলায় স্থানীয় মালিকের ঘোড়াই তাকে নিতে হয়। যথারীতি পুরস্কারটাও তুলে দিতে হয় মালিকের হাতে।

মেয়ের এই অদম্য জয়ের নেশাকে দমাতে না পেরে ক্ষুদ্র মৎস্যচাষী বাবা ওবায়দুল হক তাসমিনাকে নিয়ে ছোটেন দেশের নানা প্রান্তে। এ মৌসুমে ২১টির বেশি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১৮টিতেই জয়ী হয়েছে এই বালিকা–ঘোড়সওয়ার। তাসমিনারা তিন বোন এক ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাই নূরনবী নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট বোন হালিমা পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সেও বোনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলার প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে।

তাসমিনাকে প্রথম গণমাধ্যমে নিয়ে আসে প্রথম আলো। ২০১৫ সালের ১৭ জুন সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘অধুনা’য় ‘এক দুঃখী ঘোড়সওয়ারের গল্প’ শিরোনামে তাসমিনার ঘোড়দৌড়ে জেতার গল্প ছাপা হয়। ওই বছর ঢাকার একজন ব্যবসায়ী তাসমিনাকে একটি ঘোড়া কিনে দেন। কিন্তু ঘোড়াটির এক চোখ ছিল অন্ধ। সেই ঘোড়াটি তার কোনো কাজে আসেনি। পরে অল্প দামে বাবা ওবায়দুল হক ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন।

তাসমিনাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে প্রথম আলো এবং ঘোড়া কেনার জন্য দুই লাখ টাকা দেয়। এই সহযোগিতার কথা মনে রেখেছে তাসমিনা। প্রতিযোগিতায় নামার সময় ঘোড়ার মুখের এক পাশে নিজের নাম, অন্য পাশে ‘প্রথম আলো’ লিখে নেয়। বাবা ওবায়দুল হকের বক্তব্য, ‘ঘোড়াটি যতবার পাক দেবে, দর্শকেরা ততবার প্রথম আলো লেখাটি দেখতে পাবে।’

সেই সময়ের অনুভূতি সম্পর্কে তাসমিনা বলেছিল, ‘প্রথম আলোর টাকায় কেনা আগের ঘোড়াটিও ভালো ছিল। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে কোমর ভেঙে ঘোড়াটি প্রায় অচল হয়ে যায়। তারপর আরেকটি নতুন ঘোড়া কিনেছি। ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া সবসময় নিখুঁত রাখতে হয়। একটি ঘোড়া নিয়ে বেশিদিন দৌড়ানো যায় না।’

সাধারণত শীতমৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলায় এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তখন তাসমিনার ডাক পড়ে। এবার সে শুধু বগুড়া জেলার ১০টি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। এছাড়া নওগাঁ, রাজশাহী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, চান্দাইকোনা (সিরাজগঞ্জ), ঠাকুরগাঁও, রংপুর, পার্বতীপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

তাসমিনা

গত ১২ মে তাসমিনার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল সেই মাটির ঘরই। তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, শুধু মাটির ঘরে জড়ো হয়েছে মেডেল আর অনুষ্ঠানের ব্যানার। তাসমিনা জানায়, ময়মনসিংহের খেলায় সে একটা ফ্রিজ ও একটা এলইডি টেলিভিশন পেয়েছিল। দুটোই ঘোড়ার মালিককে দিয়ে আসতে হয়েছে, কারণ ট্রাক ভাড়া করে অত দূর নিজের ঘোড়া নিয়ে গেলে যে খরচ হয়, পুরস্কারে তা পোষায় না। ঘোড়ার মালিক যাতায়াত ও থাকা–খাওয়া বাবদ খরচ দিয়েছিল। সে টাকা পথেই শেষ হয়ে গেছে। দূরের প্রতিযোগিতায় শুধু ঘোড়দৌড়ে জেতার আনন্দটুকুই  পাওয়া যায়। তবু সে খেলা ছাড়তে চায় না। যত দূরেই হোক—যেতে চায়।

তাসমিনার স্বপ্ন পুলিশের চাকরিতে যোগ দেওয়া। এত পেশা রেখে কেন পুলিশেই? উত্তরে তাসমিনা বলেন, ‘শুনেছি পুলিশ একাডেমিতে অনেক বড় বড় ঘোড়া আছে। পুলিশের চাকরি পেলে আমার সেই ঘোড়া ছোটানোর স্বপ্নটা পুরণ হবে।’

এ বছর তাসমিনা আঠারোতে পা দিয়েছেন। তার ইচ্ছা, বয়স পূর্ণ হলেই পুলিশের চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিবে। তবে বর্তমানে বাবার ব্যবসা নেই বলে ঠিকমতো  পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন না। এ নিয়ে তাসমিনার স্বপ্নময় দুচোখে খেলা করে অনিশ্চয়তার ছাপ!