আবাসনের নতুন ধারায় আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর উত্থান
স্থাপত্যশৈলী সময়ের সঙ্গে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যা প্রদর্শন করে বিভিন্ন সময়কালের মানবসভ্যতার ইতিহাস ও জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন মিসরীয় পিরামিড থেকে শুরু করে গ্রিক-রোমান স্থাপত্য, মোগল আমলের সম্রাটীয় প্রাসাদ কিংবা ইউরোপীয় রেনেসাঁর স্থাপত্য—প্রতিটি যুগই তার নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করেছে। শিল্পবিপ্লবের পর স্থাপত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বিকাশ লাভ করতে থাকে আধুনিক স্থাপত্যের ধারা। বিখ্যাত স্থপতি লে করবুজিয়ে, ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট ও মিস ভ্যান ডের রোহে মিনিমালিজম নীতির ভিত্তিতে কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং পরিচ্ছন্ন স্থাপত্যশৈলীর প্রচলন ঘটান। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আধুনিকতার ধারা ক্রমেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
আধুনিক স্থাপত্যশৈলী ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকে স্থাপত্যশৈলীর এই পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্ট। তবে বাংলাদেশের স্থাপত্যশৈলীর কথা বলতে গেলে চলে আসে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নাম। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক স্থপতি। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘আধুনিক স্থাপত্যকর্মের পথপ্রদর্শক’। তাঁর স্থাপত্যকর্মগুলো বাংলাদেশের ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সুচিন্তিত বিবেচনার প্রকাশ। উপনিবেশ-উত্তর পরিবেশে এ–জাতীয় আধুনিক ভাবনা-আশ্রিত স্থাপত্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছিল অত্যন্ত দুরূহ। সেই দুরূহ কাজটিই দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।
মিনিমালিজম বনাম লাক্সারি ডিজাইন
আবাসনে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত দুটি ট্রেন্ড হলো ‘মিনিমালিজম’ ও ‘লাক্সারি ডিজাইন’। এই দুটি ধারা দর্শনে সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও উভয়ই শহুরে জীবনের আবাসনে নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে।
মিনিমালিজম মূলত ‘সরলতাই সৌন্দর্য’ ধারণাকে তুলে ধরে। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো, অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিয়ে একটি পরিষ্কার, খোলামেলা এবং কার্যকরী পরিবেশ তৈরি করা। কম আসবাব, খোলামেলা স্থান, প্রাকৃতিক আলো ও বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহারই এর প্রধান দিক। মিনিমালিস্ট ডিজাইন মানসিক শান্তি ও শৃঙ্খলা আনতে সাহায্য করে, কারণ এটি জায়গার সংকুলান ও অগোছালো জীবন থেকে মুক্তি দেয়। দীর্ঘমেয়াদি সাশ্রয় এবং জিনিসপত্রের কম ব্যবহারের কারণে এটি পরিবেশগতভাবেও বেশি টেকসই। তবে অনেকেই এই ট্রেন্ডকে অতিরিক্ত সাদামাটা ভাবেন। তাঁরা বেছে নেন লাক্সারি ডিজাইন।
লাক্সারি ডিজাইনগুলো মূলত শহুরে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয়। বিশালাকার কক্ষ, ঝকঝকে ইন্টেরিয়র, প্রিমিয়াম উপকরণ এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এ ধরনের ডিজাইন গড়ে ওঠে। লাক্সারি ডিজাইন মূলত স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতা দুটোকেই নিশ্চিত করে।
এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ জেড এম তানভীর আহাদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলী আসলে এলাকাভেদে ভিন্ন। যেমন গুলশান, বনানী কিংবা বারিধারারার দিকের প্রকল্পগুলোর স্থাপত্যশৈলী লাক্সারিয়াস। আবার আফতাবনগর কিংবা মিরপুরের দিকের প্রকল্পগুলোর স্থাপত্যশৈলী সে তুলনায় সরল। তবে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এত বেশি লাক্সারি পছন্দ করেন না। তাঁরা মিনিমালিস্ট ধারাই বেশি পছন্দ করছেন।’
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্টাইল
স্থাপত্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয় হলো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্টাইল। স্থানীয় স্থাপত্য প্রায়ই পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উঁচু ছাদ, খোলা বারান্দা এবং বাতাস চলাচলের খোলা জায়গা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্টাইল গ্লোবাল ট্রেন্ডের অনুসরণে তৈরি।
এ বিষয়ে এ জেড এম তানভীর আহাদ বলেন, ‘বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু স্থানীয় কিংবা আন্তজার্তিক ধাঁচের স্থাপত্যশৈলী তৈরি করা যুগোপযোগী নয়। এই সময়ে ভবনগুলো নির্মাণের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কীভাবে দুটি ধারার সমন্বয়ে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।’
টেকসই নকশার প্রয়োজনীয়তা ও চ্যালেঞ্জ
ভবিষ্যতের স্থাপত্যশৈলীতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ডিজাইনই হবে মুখ্য। সোলার প্যানেল, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, গ্রিন রুফ এবং এনার্জি-সাশ্রয়ী উপকরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক স্থাপত্যে টেকসই নকশা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পৃথিবী নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এই টেকসই নকশা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রাথমিক বিনিয়োগ এবং সচেতনতার অভাব। সোলার প্যানেল বা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম ইনস্টল করার জন্য প্রথম দিকে খরচ অনেক বেশি হয়। এ ছাড়া নতুন প্রযুক্তি এবং উপকরণের সহজলভ্যতাও একটি বড় বাধা। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া টেকসই স্থাপত্যের প্রসার ঘটানো বেশ কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।