সমুদ্রের রোমাঞ্চকর গল্প বলেন মারুফ, শোনান গান

সমুদ্রগামী জাহাজে বসে অবসরে ভ্লগ করেন আবদুল্লাহিল মারুফ
ছবি: সংগৃহীত

নিঃসীম সমুদ্র। বিশাল বিশাল ফণা তোলা সব ঢেউ। মাঝসমুদ্রে থাকা জাহাজের গায়ে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে একেকটা ঢেউ। মুহূর্তেই বাষ্পের মতো ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের নোনা পানি। ভয়ংকর গর্জনে সমুদ্র তার খ্যাপাটে ভাবের জানান দেয়। এই গর্জনে গায়ে কাটা দেয়। কখনো আবার সমুদ্র থাকে শান্ত। পাটি বিছানো নীল সমুদ্রের দিগন্তরেখায় হেসে ওঠে রংধনু। সমুদ্রের এমন সব বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরেন আবদুল্লাহিল মারুফ।

মারুফ পেশায় নাবিক। সমুদ্রগামী জাহাজে বসে অবসরে তিনি ভ্লগ করেন। ভ্লগিংয়ের মাধ্যমে এই তরুণ তুলে ধরেন সমুদ্র, সমুদ্রযাত্রা, সমুদ্রচারী জীবনের নানা দিক। দারুণ গানও করেন মারুফ। জাহাজে বসে তাঁর করা গানে মুগ্ধ হন নেটিজেনরা। তাঁর গান, ভ্লগ লাখো দর্শক দেখেন। তাঁরা তাঁকে প্রশংসায় ভাসান।

সমুদ্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরেন আবদুল্লাহিল মারুফ
ছবি: সংগৃহীত

হংকংভিত্তিক একটি অয়েল ট্যাংকারে ‘সেকেন্ড অফিসার’ হিসেবে কর্মরত মারুফ। তাঁর জাহাজের বর্তমান অবস্থান বোহাই উপসাগর। পীত সাগরের গভীরতম এই উপসাগরে বসে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মারুফ শোনান তাঁর নাবিক হওয়া, ভ্লগিং, গানসহ সমুদ্রযাত্রার রোমাঞ্চকর সব গল্প।

রাজশাহীর মতিহার থানার মৌলভী বুধপাড়ার ছেলে মারুফের নাবিক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এমনকি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রকৌশল (আইসিই) বিভাগেও ভর্তি হয়েছিলেন। এক বছরের মাথায় সিদ্ধান্ত বদল। নাবিক হওয়ার জন্য মনস্থির করেন তিনি। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৩ সালে শিক্ষানবিশ নাবিক হিসেবে তিনি যোগ দেন সমুদ্রগামী জাহাজে।

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুরস বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স করেন তিনি। এক বছরের কোর্স শেষে তৃতীয় অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে হন দ্বিতীয় অফিসার। এখন তাঁর মূল কাজ জাহাজের যাত্রাপথের পরিকল্পনা, যাত্রাপথ পর্যবেক্ষণ, নেভিগেশনাল ওয়াচ, কার্গো ওয়াচ।

আবদুল্লাহিল মারুফের ভ্লগ, গান লাখো দর্শক দেখেন
ছবি: সংগৃহীত

নাবিক হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৫টির বেশি দেশে গেছেন মারুফ। সমুদ্রযাত্রা করেছেন প্রায় ৪০টি। ২০২১ সালের আগস্টে চীন থেকে ভেনেজুয়েলা যাওয়ার পথে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে বড় ঝড়ের কবলে পড়েছিল মারুফের জাহাজ। কী মনে করে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ভিডিও ধারণ করেন তিনি। নিজের ফেসবুক পেজে ভিডিওটি প্রকাশ করেন। হাজারো মানুষ ভিডিওটি দেখেন।

তাঁরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানান। অনেকে সমুদ্রযাত্রার নানা গল্প জানার আগ্রহ দেখান। এই ঘটনার পরই সমুদ্রযাত্রা নিয়ে ভ্লগ করার ভাবনা মাথায় আসে মারুফের। তিনি বলেন, ‘আমার ভ্লগিংয়ের উদ্দেশ্য হলো, সমুদ্রযাত্রার অজানা দিকগুলো বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে খুব সাধারণভাবে তুলে ধরা।’

‘সেইল উইথ মারুফ’ নামের ফেসবুক পেজে এখন পর্যন্ত ৪০টির মতো ভিডিও আপলোড করেছেন এই নাবিক। এসব ভিডিওতে সমুদ্র, ঝড়ঝঞ্ঝা, ঢেউ, সমুদ্রযাত্রা, বন্দর, জাহাজের অভ্যন্তরীণ নানা কারিগরি বিষয়, জাহাজ পরিচালনা, নাবিকদের কাজ, খাওয়াদাওয়াসহ হরেক কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ রয়েছে। মারুফ বলেন, ‘প্রতিটি ভিডিওতেই আমি নতুন কিছু দেখানোর চেষ্টা করি।’

মারুফের প্রতিটি ভিডিওতে লাখো ভিউ হয়। এক ভিডিওতে সর্বোচ্চ ভিউ এসেছিল ৪৭ লাখ। মারুফ বলেন, ‘আমার ভিডিওর মাধ্যমে দেশে বসেই মানুষ সমুদ্রের জীবনযাত্রা দেখতে পান, তাঁর রোমাঞ্চিত হন, এই বিষয় আমাকে ভীষণ আনন্দ দেয়। আর আমার অবসর সময়টাও এসব নিয়ে বেশ ভালোই কেটে যায়।’

হংকংভিত্তিক একটি অয়েল ট্যাংকারে ‘সেকেন্ড অফিসার’ হিসেবে কর্মরত আবদুল্লাহিল মারুফ
ছবি: সংগৃহীত

অবসরে আরেকটা কাজ করেন মারুফ। তিনি জাহাজে বসে হাতে তুলে নেন ইউকেলেলে। দরদভরা কণ্ঠে তোলেন সুর। গেয়ে ওঠেন, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘আহারে জীবন’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব’, ‘দিন যায়, কথা থাকে’, ‘ওকি একবার আসিয়া সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়া রে’, ‘কি নামে ডেকে বলব তোমাকে’, ‘প্রেমে পড়া বারণ’, ‘যদি হিমালয় হয়ে’ এমন সব গান।

হিন্দি গানেও সমান পারদর্শী তিনি। মারুফ অধিকাংশ গান জাহাজের ব্রিজে বসে করেন। সেখান থেকে সহজেই সমুদ্র দেখা যায়। তাঁর গান সমুদ্রের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ‘মারুফ’ নামের ফেসবুক পেজে গানগুলো প্রকাশ করেন এই নাবিক। তাঁর গানের ভিডিওতে লাখ লাখ ভিউ হয়।

ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা মারুফের। তবে গানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা তাঁর নেই। শুনে শুনে গান রপ্ত করেছেন তিনি। মারুফ বলেন, পরিবার থেকে বহু দূরে, সমুদ্রচারী জীবনের নানা বাঁকে গানই আমাকে উজ্জীবিত রাখে।’