বাংলাদেশের দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার সাংবাদিক জাইমা ইসলাম পত্রিকাটির শুক্রবারের সংস্করণের জন্য প্রতিবেদন জমা দিচ্ছিলেন। (আগের দিন রাতে) ঠিক ওই সময় মব আক্রমণকারীদের হইচই শোনা যাচ্ছিল। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় তিনি দ্রুত বের হতে চাইলেন। কিন্তু যখন তিনি দরজার কাছে পৌঁছালেন, আক্রমণকারীরা ততক্ষণে সেখানে হাজির। এর আগেই বাংলাদেশের আরেকটি নামকরা পত্রিকা প্রথম আলো কার্যালয়ে আগুন দেয় মব আক্রমণকারীরা।
শরিফ ওসমান বিন হাদি নামের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের সুপরিচিত এক নেতাকে হত্যার ঘটনায় দাঙ্গাকারীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ওই আন্দোলনের মাধ্যমে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, হত্যাকারীরা শেখ হাসিনার অনুসারী; তাঁরা ভারতে পালিয়ে গেছেন। ১৮ ডিসেম্বর রাতে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরে ক্ষুব্ধ লোকজন আগের সরকারের সঙ্গে যুক্ত মনে করেছেন, এমন ব্যক্তিদের ওপর হামলা চালাতে উদ্ধত হন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে হামলা, নিপীড়ন ও মামলার শিকার হওয়া সত্ত্বেও প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারকেও লক্ষ্যবস্তু করা হলো।
সেই রাতে দুটি সংবাদপত্রের কার্যালয় এবং একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের মাত্র ১৫ মাসের মাথায় বাংলাদেশের গতিপথ নিয়ে সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের মধ্যে এটি গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। অথচ এই গণ-অভ্যুত্থান নতুন একধরনের রাজনীতির আশা জাগিয়েছিল।
নভেম্বর পর্যন্ত মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত মব আক্রমণের শিকার হয়ে ১৮৪ জন নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ধর্ম অবমাননার গুজবে এক হিন্দু পোশাকশ্রমিককে টেনেহিঁচড়ে বের করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশে মব আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫১।
১৮ ডিসেম্বর যখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন ৩৫ বছর বয়সী প্রতিবেদক জাইমা ইসলাম ও তাঁর ২৮ জন সহকর্মী বাঁচার আশায় ছাদে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই জানতাম যে এই মব কেবল অফিস ভাঙচুর করেই ক্ষান্ত হবে না, তারা এখানে আগুন ধরিয়ে দেবে।’
একপর্যায়ে ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল এবং ধোঁয়া এতই ঘন ছিল যে হাতে থাকা ফোনটিও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। তখন জাইমা ইসলাম ফেসবুকে একটি বার্তা পোস্ট করেন, যেটিকে তিনি তাঁর শেষ বার্তা ভেবেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না। অনেক বেশি ধোঁয়া। আমি ভেতরে আটকা পড়েছি। তোমরা আমাকে মেরে ফেলছ।’
এই সহিংসতা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে হিমশিম খাওয়ার উদাহরণ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাড়তে থাকা উত্তেজনা এই সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে, এ ঘটনা তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা হয়েছে অনেক সতর্কবার্তা পাওয়ার পর; ততক্ষণে প্রথম আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। উভয় সংবাদপত্রের সাংবাদিকেরা সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ফোনে সাহায্য চেয়েছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন মই ব্যবহার করে কয়েকজন কর্মীকে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন, তখন তাঁদের ওপরও হামলাকারীরা চড়াও হয়। শেষ পর্যন্ত রাত প্রায় চারটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুকে লেখেন—তিনি বহুবার ‘সঠিক ব্যক্তিদের’ ফোন করেছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। পরে তিনি লেখেন, ‘মনে হচ্ছে, লজ্জায় আমি যদি গর্ত করে নিজেকে মাটিচাপা দিতে পারতাম।’
প্রথম আলোর এক সাংবাদিক বলেন, ১৩ তলা ভবন থেকে নিচের লোকজনকে দেখে তাঁর মনে হয়েছে—২০২৪ সালের আগস্টে যে আশার কথা বলা হয়েছিল, সেখান থেকে দেশ কত দূরে সরে গেছে।
শেখ হাসিনার সময় বিরোধী দল দমন করা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর যখন তাঁর পতন হলো, তখন তরুণ আন্দোলনকারীদের নেতারা ‘বাংলাদেশ ২.০’–এর কথা বলেছিলেন, যেখানে পুরোনো সহিংস রাজনীতি থাকবে না।
ওই সাংবাদিক বলেন, ‘আমি (এই আন্দোলনে) অংশ নিয়েছিলাম, কারণ (হাসিনার) আওয়ামী লীগ শাসনের অধীনে আমরা ১৫ বছর ধরে যেন এক অন্ধকার কারাগারে ছিলাম। কিন্তু গত ১৬ মাসে প্রথমবারের মতো আমার মনে হয়েছে, আমরা কি তবে একেবারে তলানিতে নেমে গেলাম?'
তিনি বলেন, আগের সরকারের সময়ের তুলনায় এখন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা নিয়ে প্রতিবেদন করতে তিনি সাধারণভাবে বেশি স্বাধীনতা অনুভব করেছেন, কিন্তু সহিংসতা তাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।
ওই সাংবাদিক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সময়টা খারাপ ছিল—প্রথম আলোকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, আক্রান্তও হয়েছিল। কিন্তু এভাবে হামলার শিকার হওয়া এবং সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা না পাওয়াটা (মর্মান্তিক), তারা মবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।’
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সাংবাদিক জিয়া চৌধুরী বলেন, সব সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের অধিকার কর্মীরা এখন নিজেদের অসহায় মনে করছেন। মাঠে গিয়ে প্রশ্ন করলেই হামলার ভয় কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক আশা ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আশা শেষ হয়ে গেছে।’
জাইমা ইসলাম বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী লোকজনের ওপর গুলি চালাক, তা তিনি চাননি। কিন্তু সাংবাদিকদের রক্ষা করার জন্য আরও অনেক কিছু করা উচিত ছিল।
২০২৪ সালের আন্দোলনে হাসিনার বাহিনীর হাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন। এরপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ মনে করে লোকজনের ওপর হামলা হয়। বাংলাদেশ প্রতিশোধের এই চক্রে আটকা পড়েছে বলেও উদ্বিগ্ন জাইমা। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার যেন প্রকৃত অপরাধীদেরই করা হয়। শুধু দেখানোর জন্য গণহারে আটক করলে প্রতিশোধের সংস্কৃতি আরও শক্ত হবে।
জাইমা ইসলাম বলেন, ‘আমি এখনো একটু আশা রাখছি। এখনো পুরো আতঙ্কে পড়ে যাওয়ার সময় হয়নি।’