যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, ৭ মাসে ২৭ প্রাণহানি

চালকদের অসচেতনতা ও অতিরিক্ত গতিই দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ। হাইওয়ে পুলিশ বলছে, তারা মামলা ও জরিমানা করছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে
ফাইল ছবি

পদ্মা সেতু চালুর পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা থেকে ঢাকায় যান চলাচল বেড়েছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়িগুলো ঢাকায় যাতায়াত করে। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এ মহাসড়কে গত ৭ মাসে ১৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৭ জন। এসব দুর্ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র একটি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চালকদের অসচেতনতা ও অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে আরও যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ। তবে হাইওয়ে পুলিশ বলছে, অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে তারা নিয়মিত চালকদের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করছে। এরপরও চালকেরা সতর্ক হচ্ছেন না।

হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৬ জুন থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে ১৭টি দুর্ঘটনায় ২৭ জন ব্যক্তি মারা গেছেন। ১৭ জানুয়ারি ভোরে পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজার সামনে নাওডোবা এলাকায় রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ট্রাকের মধ্যকার দুর্ঘটনায় রোগী, চালকসহ অ্যাম্বুলেন্সের ছয় যাত্রী নিহত হন। দুর্ঘটনার পর ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সটি জব্দ করা হলেও কোনো মামলা হয়নি। গত ৫ নভেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গার সলিলদিয়া এলাকায় প্রাইভেট কার দুর্ঘটনায় মা–বাবা ও মেয়ে নিহত হন। সেতু চালুর পর ২ জুলাই বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে সেতু দেখতে আসা এক পর্যটক নিহত হন।

এ ছাড়া উদ্বোধনের পরের দিন ২৬ জুন মোটরসাইকেল উল্টে দুই তরুণ ও ১৭ জুলাই ট্রাক উল্টে দুজন নিহত হন। এভাবেই প্রতিনিয়ত এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে।

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করেছে সরকার। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েকে বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ২৬ জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ২৭ লাখ ৫০ হাজারটি। প্রতিদিন গড়ে যানবাহন পারাপার হয়েছে ১৪ হাজারের মতো। যা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বিভিন্ন জেলায় চলাচল করছে। মহাসড়কটিতে যানবাহনের গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু কোনো যান চালকেরা এ নির্দেশনা মানছেন না। তারা ঘণ্টায় ১০০ হতে ১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। উচ্চগতিতে গাড়ি চালানোর কারণে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শরীয়তপুরের সভাপতি মুরাদ হোসেন মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের গতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কম গতি, মধ্যম গতি ও সর্বোচ্চ গতিসীমায় গাড়ি চালানোর জন্য আলাদা লেন করে দেওয়া হয়েছে। যে গাড়ির যেমন গতি, সেই গাড়ি নির্দিষ্ট লেন ধরে চলাচল করবে। কিন্তু কোনো যানবাহনের চালকেরা ওই নিয়ম মানেন না। এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলেই চালকেরা বেপরোয়া হয়ে যান। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর নেশায় মেতে ওঠেন। তিনি বলেন, গতিসীমা নিয়ে চালকদের সচেতন করা দরকার। ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে পালন করাও জরুরি। এ জন্য পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক্সপ্রেসওয়ের এক বাসচালক প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলায় চলাচলকারী অধিকাংশ বাস ও ট্রাকের রুট পারমিট নেই। ওই সব গাড়ির চালকেরা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান। ছোট গাড়ির চালকেরা দক্ষ নন। দূরপাল্লার গাড়ি চলে অতিরিক্ত গতিতে। তখন সড়কে যান চালকেরা গতি সমন্বয় করতে পারেন না। এতে দুর্ঘটনা ঘটে।

হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মাহাবুবুল আলম বলেন, পদ্মা সেতুর সুফল পাওয়ায় ভাঙ্গা-মাওয়া-ঢাকা মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। মহাসড়কে গাড়ি উঠলেই চালকেরা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান। দ্রুত সেতু পার হতে পেরে এবং মহাসড়ক ফাঁকা পেয়ে নির্বিঘ্নে গাড়ি চালাতে পারার কারণে চালকেরা কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে চান। সেতু চালু হওয়ার পর যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই ঘটেছে।

মাহবুবুল আলম আরও বলেন, ‘আমরা গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি, জরিমানা করছি। প্রতি মাসে তিন থেকে চার হাজার মামলা দেওয়া হচ্ছে। এরপরও চালকেরা সচেতন হচ্ছেন না। দুর্ঘটনার পর ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করতে আগ্রহী হয় না। তারা পুলিশকেও মামলা করতে নিরুৎসাহিত করে।’