রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত হোক যুবকদের কণ্ঠ

‘বাংলাদেশের যুব সমাজ ও এসডিজি: আজকে দাঁড়িয়ে আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এ সম্মেলন আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম।

এম এ মান্নান,সুলতানা কামাল,দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য,স্টেফান লিলার

ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় তরুণ সমাজকে যুক্ত হয়ে নিজেদের নাগরিক অধিকার চর্চা করতে হবে। যুবসমাজের একটি অংশ উগ্রবাদ, মাদকাসক্ত, বিষণ্নতায় ডুবে আছে, যাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সম–অধিকার চর্চায় তরুণ সমাজকে সোচ্চার হতে হবে।

রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে গতকাল বৃহস্পতিবার এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের যুব সমাজ ও এসডিজি: আজকে দাঁড়িয়ে আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক দিনব্যাপী যুব সম্মেলনে এসব আহ্বান জানানো হয়। এ আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ইউএনডিপি, ইউনাইটেড নেশনস পোভার্টি–এনভায়রনমেন্ট অ্যাকশন। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ সম্মেলন করা হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, যাঁরা নগরে বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যেই ‘নাগরিক’ শব্দটা সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়। এর বাইরেও একটি সমাজ রয়েছে। এই গোষ্ঠীরও হক আছে, পাওনা আছে। সেগুলোকে স্বীকার করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, গ্রামের মানুষের চাওয়া হচ্ছে, তার বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণ। অন্যদিকে নগরের মানুষের ভাবনা হচ্ছে, সুশাসন ও মানবাধিকার। গ্রামে গেলে এই তালিকা পাল্টে যায়। গ্রামের মানুষকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, তরুণেরা সমাজের সবচেয়ে শক্তিমান অংশ। তরুণদের কাছে অনেক প্রত্যাশা। তাঁদের সুপথে পরিচালিত হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুউত্তরাধিকারী কখনো উত্তরাধিকার বেচে না, ধ্বংস করে না; বরং সমৃদ্ধ করে। তিনি আশা করেন, তরুণেরা সুউত্তরাধিকারী হবেন।

শুধু শিক্ষিত সমাজই যুবসমাজের অংশ নয়, এর বাইরেও একটি যুবসম্প্রদায় আছে উল্লেখ করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই যুবসমাজ সমধর্মী নয়। ওই পিছিয়ে থাকা যুবসমাজের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাঁদের মধ্যে বেশি হচ্ছেন নারী। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে তাঁরা দূরে। যুবসমাজের অনেকে মাদকাসক্তি ও উগ্রবাদে জড়াচ্ছে, অনেকে আবার অবসাদে ভুগছে। আত্মহত্যার ঘটনা এখন দেখা যাচ্ছে। এগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর প্রশ্ন, রাষ্ট্র পরিচালনায় যুবকদের কথা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয় কি?

ভোটাধিকার প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সাম্প্রতিক জনশুমারিতে ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ২ কোটি নতুন ভোটার ২০১৮ সালের পর যুক্ত হয়েছেন। তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ভোটের তালিকায় যেন নাম থাকে, সে নিশ্চয়তা পেতে হবে। ভোট দেওয়া নাগরিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তরুণদের অনেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। সেই হিসাবে বলা যায়, ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষ প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালে হয়তো ভোটদানের সুযোগ পাবেন। যুবসমাজের কণ্ঠস্বরকে আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করতে হবে। আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনায় যুবকদের কণ্ঠ যুক্ত হতে হবে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে অর্জন, তাতে গর্ব করার অনেক কিছু আছে উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ অর্জন হয়েছে কারণ, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। স্বাধীনতা এসেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে, যার সিংহভাগ ছিলেন তরুণ। দেশের যত ইতিবাচক অর্জন আছে, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামনের কাতারে ছিলেন তরুণেরা। এই ইতিবাচক অর্জনকে এখনকার তরুণ সমাজকে টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরে। এই দুর্নীতির সমস্যা নিয়ে তরুণদেরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ, দুর্নীতির কারণে ও সুশাসনের অভাবে সমাজে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা সব নাগরিককেই প্রভাবিত করে। দুর্নীতি নামের ব্যাধির বিরুদ্ধে তরুণ সমাজকে সোচ্চার হতে হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে দিনব্যাপী বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সমান্তরাল অধিবেশন হয়। অধিবেশনে বক্তব্য দেন একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস প্রমুখ।

এবারের সম্মেলনে যুব ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। তাতে যুবসমাজের কণ্ঠস্বরকে নীতিপ্রণেতাদের কাছে পৌঁছাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, লিঙ্গভিত্তিক সমতা, সুবিধাবঞ্চিত যুবগোষ্ঠীসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেন, জাতিসংঘ তরুণদের মূলত তিন ধরনের বিষয়ে যুক্ত করতে কাজ করছে। এ তিনটি হলো শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও আর্থিকভাবে ক্ষমতায়ন করা। তাদের প্রোগ্রামের মাধ্যমে কমিউনিটিভিত্তিক সচেতনতা কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে তরুণেরা।

সিপিডির সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তরুণদের চাহিদা ও প্রাধান্যের পরিবর্তন হয়েছে। তরুণেরা এখন প্রশ্ন করতে শিখেছেন। তরুণদের এই প্রশ্নেই সমাজের দায়বদ্ধতার বিষয় চলে আসে। তরুণদের বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি। পাশাপাশি নিজের প্রতি বিনিয়োগ করে তরুণদের সমৃদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান।

এখনকার তরুণেরা সরকারি চাকরির দিকে বেশি ঝুঁকছেন বলে জানান বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যত বেশি মানুষ শিক্ষিত হচ্ছেন, বেকারত্বের হারও তত বাড়ছে।

যুব সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস, নিউএজ গ্রুপ অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, ব্র্যাকের পরিচালক (জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি) নবনীতা চৌধুরী ও চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী।

এ সম্মেলনের সহযোগী হিসেবে ছিল একশনএইড বাংলাদেশ, এডুকো, ফ্রেডরিক ইবার্ট স্টিফটাং, হেকস ইপার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ওয়াটার এইড, ইউএনওয়াইএসএবি।