রাষ্ট্রপতির হাতে এল কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা

প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। গত ৫০ বছরে এ সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন শুধু ‘তাত্ত্বিক’ বিষয় নয়, সব সময় এর একটি প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য থাকে। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংকট, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা, সামরিক শাসন, সরকারগুলোর কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা—এ সবকিছুই সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে আট পর্বের এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রতি রোববার প্রকাশিত হচ্ছে। আজ তৃতীয় পর্ব

আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ১৯৭৪ সাল ছিল একটি কঠিন সময়। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং ‍দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা—এ সবকিছুই জনগণের কাছে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হতে থাকে। এ ছাড়া রক্ষী বাহিনীর ভূমিকা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠছিল। একদিকে সরকারি দমনপীড়ন, অন্যদিকে জাসদ ও অন্যান্য চরমপন্থী দলের সহিংস কর্মকাণ্ডে রাজনীতির মাঠ তখন যথেষ্ট উত্তপ্ত। এ রকম পরিস্থিতিতে ’৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

জরুরি অবস্থা জারির কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধিতাকারীরা নানা রকম ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে। এর ফলে দেশের অস্তিত্বের ওপর হুমকি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া চোরাচালান, কালোবাজারি, মজুতদারি এবং বিভিন্ন চরমপন্থী দলের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড বন্ধের কথাও বলা হয়।

কিন্তু যেসব অপরাধ দমনকে সামনে রেখে জরুরি অবস্থার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা লক্ষ করা যায়নি। এর ফলে জরুরি অবস্থা জারির পরেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। দেশের শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, ’৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই এ রকম গুঞ্জন শোনা যায়। ঘটনাপ্রবাহ থেকে এমনটি প্রতীয়মান হয়, ওই পরিবর্তনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবেই ২৭ দিন আগে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

চতুর্থ সংশোধনী

চতুর্থ সংশোধনী বিলটি সংসদে পাস হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বিলটি উত্থাপন করেছিলেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগেরই দুজন সংসদ সদস্য জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম এ জি ওসমানী এবং মইনুল হোসেন সংসদে ভোটের সময় অধিবেশন বর্জন করেন। বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য বিলটি নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে তেমন কোনো আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ না দিয়েই বিলটি পাস হয়। সেদিনই রাষ্ট্রপতি বিলটি অনুমোদন করেন।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা কায়েম করে সর্বময় ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে চতুর্থ সংশোধনীর প্রভাব ছিল ব্যাপক। কিন্তু দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকায় বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রগুলো ছিল প্রায় নীরব। একই কারণে অন্যদের পক্ষেও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ ছিল না।

আরও পড়ুন

বাকশাল গঠন

চতুর্থ সংশোধনীর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল একদলীয় শাসনব্যবস্থা। সংবিধানে একটি নতুন ভাগ (ষষ্ঠ-ক ভাগ) যুক্ত করে তাতে বলা হয়, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির যেকোনো একটি পুরোপুরি কার্যকর করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন, দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকা দরকার, তাহলে তিনি সেই মর্মে ঘোষণা দেবেন। এতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রপতি যদি একটি রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন, তাহলে ১. দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হবে; ২. রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন; ৩. সরকারি কর্মচারীরাও জাতীয় দলের সদস্য হতে পারবেন; ৪. জাতীয় দল কর্তৃক মনোনীত না হলে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না এবং ৫. যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় দলে যোগদান করতে হবে। জাতীয় দলে যোগদান না করলে তাঁরা সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ক্ষমতাবলে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে নতুন একটি দল গঠন করা হয়। এর ফলে অন্য সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটে। দেশে জারি হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা।

সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধের ঘোষণা

চতুর্থ সংশোধনীর পর ক্ষমতাসীন সরকার প্রথমেই বিরোধী দল জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ–এর ওপর খড়্গহস্ত হয়। পত্রিকাটির অফিসে পুলিশ পাঠিয়ে তাদের সব সম্পত্তি জব্দ করা হয়। ’৭৫ সালের ১৬ জুন সরকার সংবাদপত্র অধ্যাদেশ জারি করে।

এর ফলে চারটি ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয় এবং চারটি সংবাদপত্র প্রকাশনার দায়িত্বও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। এ চারটি সংবাদপত্র ছিল দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, বাংলাদেশ টাইমস এবং বাংলাদেশ অবজারভার। চতুর্থ সংশোধনীর ফলাফল হিসেবে তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যেখানে না ছিল কোনো বিরোধী দল, না ছিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।

সবকিছুর ওপরে রাষ্ট্রপতি

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা কায়েম করে সর্বময় ক্ষমতা তাঁর হাতে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। সংবিধান সংশোধনে প্রয়োজন ছিল সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অথচ সংবিধানের ক্ষমতাবলে সৃষ্ট রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার জন্য তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান রাখা হয়েছিল। স্পষ্টতই, রাষ্ট্রপতিকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া এবং তাঁকে অপসারণ করার সম্ভাব্য সব পথ বন্ধ করতেই এমন বিধান রাখা হয়েছিল। ’৭২-এর মূল সংবিধান অনুসারে দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে কেউ থাকতে পারতেন না। চতুর্থ সংশোধনীতে এই বিধান উঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ক্ষমতা স্থায়ীকরণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল।

চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। সেই অনুসারে নতুন রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে হতো। কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য চতুর্থ সংশোধনীর চতুর্থ তফসিলে শর্ত জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘(ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি–পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে; (খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি-পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।’

লক্ষণীয় হলো চতুর্থ সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ার পরেই পদত্যাগ করার সুযোগ না দিয়েই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

চতুর্থ সংশোধনীর ফলাফল

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের যে পদক্ষেপ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক বা সমালোচনা হয়েছে, তা হলো চতুর্থ সংশোধনী। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আমূল বদলে ফেলা হয়েছিল। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে ন্যূনতম ভারসাম্য ছিল, সেটাও ধ্বংস হয়ে যায়।

এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো যে সংকটের মুখে পড়ে, তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। মওদুদ আহমদ তাঁর বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল বইয়ে লিখেছেন, ‘...চতুর্থ সংশোধনীর ফলে এত দিনের সংগ্রামে গড়ে তোলা রাষ্ট্রের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এক আঘাতে চুরমার হয়ে যায় এবং দেশের একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যুদয় সূচিত হয়।

যে আইনসভা সর্বোচ্চ ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান ও আইনের চূড়ান্ত উৎস হিসেবে অবস্থান করছিল, তা রাষ্ট্রের জন্য কেবলমাত্র একটি আলংকারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

যেকোনো বিলে অসম্মতি জ্ঞাপনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পিত হওয়ায় জাতীয় সংসদ একটি নিরর্থক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যে বিচার বিভাগ তার স্বাতন্ত্র্যমুখী অস্তিত্ব বজায় রেখে দেশে আইন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর অবদান রাখছিল, চতুর্থ সংশোধনীর পর তা কেবলমাত্র নির্বাহী বিভাগের করুণার পাত্র হিসেবে অবস্থান করতে থাকে।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ করার প্রশাসনিক ও তত্ত্বাবধায়ক দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হওয়ায় গোটা বিচার বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগের একটি অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাত থেকে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের ক্ষমতা প্রত্যাহার করায় এবং একদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করে অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেওয়ায় নয়া রাষ্ট্রপতি নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের সকল ক্ষমতার একক ও সর্বশক্তিমান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।…’

অনেকে অবশ্য চতুর্থ সংশোধনীর প্রেক্ষাপটকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য তাঁরা জাসদ ও সশস্ত্র ‘বিপ্লবে’ বিশ্বাসী অন্য বামপন্থী দলগুলোর তৎপরতাকে দায়ী করেন। এ ছাড়া আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ যে সংকট তৈরি করেছিল, সেটি শেখ মুজিবুর রহমানকে বাকশাল গঠন করতে বাধ্য করেছিল বলে কেউ কেউ বলেন।

কিন্তু একদলীয় শাসন কায়েমের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর অনাস্থার প্রকাশ ঘটেছিল। বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ বইয়ে রওনক জাহান লিখেছেন, সংসদে সাংবিধানিক পরিবর্তনগুলোর সূচনা করে শেখ মুজিব ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ‘ব্যবস্থা’ পরিবর্তন করছেন। কেননা, পুরোনো ব্যবস্থা একটা ‘ফ্রিস্টাইল গণতন্ত্র’, যা দেশের প্রকৃত সমস্যার সমাধানে সক্ষম নয়।

সংসদীয় ব্যবস্থার ‘ব্যর্থতা’ ও একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ হিসেবে যাঁরা বিরোধী দলগুলোর তৎপরতাকে দায়ী করেন, তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন রওনক জাহান। একই বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘…সংসদীয় ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা ছিল সরকারের অকার্যকারিতা। পরিকল্পনাগুলো কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি এবং সেগুলো ছিল নিছকই ঘোষণা এবং বাগাড়ম্বর। এটা জনগণের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতার জন্য গোপন কমিউনিস্ট বা সংবিধানবিরোধী দলগুলো দায়ী ছিল না। নিজের দলের সদস্যরাই সরকারের পরিকল্পনাগুলোতে বাধা দেয় এবং বিরোধিতা করে। আওয়ামী লীগ এবং এর উপদলগুলো ছিল সরকারের মূল সমস্যা।…’

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে অন্য সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই রাজনীতির পটপরিবর্তন হয়। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা এক নৃশংস ও দুঃখজনক ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পর ’৭৫ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এক ঘোষণার মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা-সংক্রান্ত বিধান তথা সংবিধানের ‘ষষ্ঠ-ক ভাগ’ বাতিল করেন।

চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ

হাইকোর্টে দায়ের করা একটি মামলায় (হামিদুল হক চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ) চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে আদালত কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। এতে বলা হয়, চতুর্থ সংশোধনীর ফলে সংবিধানের এমন পরিবর্তন হয়েছে, যার সঙ্গে মূল সংবিধানের কোনো সাদৃশ্য নেই। এটা সংবিধানের মৌলিক এবং অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবর্তন ও ধ্বংস করেছে।

আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণগুলো উল্লেখ করে সংবিধানবিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে—(সংবিধানের) ষষ্ঠ-ক ভাগে এমন বিধান অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সংবিধানের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে গুরুতর আঘাত দেওয়া হয় এবং এটা সামরিক একনায়কতন্ত্রের পথ সুগম করে। তবে আদালতের ওই রায়ে চতুর্থ সংশোধনী অকার্যকর ঘোষণার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ, মামলার রায়ের আগেই সরকার পরিবর্তন হয়েছিল।

তথ্যসূত্র

১. মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ইউপিএল

২. রওনক জাহান, বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ, ইউপিএল

৩. মাহমুদুল ইসলাম, কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, মল্লিক ব্রাদার্স