‘অগ্নিবীণা’র শতবর্ষে নজরুলজয়ন্তী

কাজী নজরুল ইসলাম
ছবি: নজরুল, দ্য পোয়েট রিমেমবার্ড বই থেকে নেওয়া

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের আগপর্যন্ত বাঙালির সাহিত্য ব্যাকুল ছিল মূলত আদর্শের খোঁজে ও নির্মাণে। আদর্শের এই অনুসন্ধান ও নির্মাণে ইংরেজ উপনিবেশের ভাবাদর্শ আর সাহিত্যরুচি বড় ভূমিকা রাখে। কলোনির ভূখণ্ডে যা হয়, বাঙালির জগৎও তার বাইরে ছিল না। কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব সেই সময়ে।

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাবের আগেই উপনিবেশের শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন মাথা তুলতে শুরু করেছে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার দিক থেকে মোহমুক্তির আবহাওয়া গড়ে ওঠে। দেশ ও নিজেদের রুচির ধারণা মাথাচাড়া দেয়।

নরের সঙ্গে নারী বা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের পাশাপাশি কবিতা আর সাহিত্যের ধারণা তখন ব্যাপকভাবে বদলাতে শুরু করেছে। সময়ের সেই বদলকে সর্বাত্মকভাবে সে সময় যিনি কবিতায় মূর্ত করলেন, তিনি নজরুল। তাঁর সমকালে এবং কিছুটা পরে নতুন রুচির পসরা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকেরাও হাজির হয়েছেন। ফলে ওই দ্বিতীয় দশকেই নতুনের সঙ্গে পুরোনো নন্দনের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

নতুন যুগের সাহিত্যিকদের সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, তাদের ‘কলমের আব্রু ঘুচে গেছে’। নজরুল ছিলেন এই ‘বেআব্রু’ প্রজন্মের প্রধান সাহিত্যিক। কবিতায় তিনি ব্যক্তি ও জনমানুষের গর্জন তুললেন, পুরোনোকে ধ্বংসের ডাক দিলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে কশাঘাত করতে থাকলেন।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা এসবেরই কাব্যিক প্রকাশ। প্রথম বইয়েই বাজিমাত করলেন নজরুল। কবি হিসেবে শক্ত আসন গেড়ে বসলেন। মানুষ তাঁর কবিতায় নিজেদের হৃদয়ের আহ্বান শুনতে পেল। অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে। এই বইয়ের শতবর্ষে আজ এল নজরুলের জন্মদিন।

ধূমকেতু পত্রিকায় ১৯২২ সালের ২০ অক্টোবর ছাপা হওয়া একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়, অগ্নিবীণা ছাপা হচ্ছে। এর চার দিন পর ২৪ অক্টোবর ধূমকেতুর পরবর্তী সংখ্যায় আরেকটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়, অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়েছে। ওই দুই বিজ্ঞাপন থেকে ধরে নেওয়া যায়, কাব্যগ্রন্থটি ১৯২২ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবরের মধ্যে কোনো একদিন বেরিয়েছিল। বইয়ের কবিতাগুলো ছিল আগুনের ফুলকিতে ভরা। রাজনৈতিক ঝুঁকির আশঙ্কায় কেউ এগিয়ে না আসায় প্রকাশক হিসেবে ছাপা হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামেরই নাম।

অগ্নিবীণার প্রথম সংস্করণের দুই হাজার কপি এক বছরের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। পর পর এক বছরের ব্যবধানেও বিক্রি হয়ে যায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণের দুই হাজার কপি। নজরুল–জীবনীকার অরুণকুমার বসু লিখেছেন, ‘সে যুগে এক বত্সরের মধ্যে কোনো কাব্যের এত বিক্রয়-সৌভাগ্য ঘটেনি।’ ১৯৩১ সাল নাগাদ ৯ হাজার টাকা মূল্যের একটি গাড়ি কেনার জন্য ডি এম লাইব্রেরির কাছে দুই হাজার টাকায় তিনি বইটির স্বত্ব বিক্রি করে দেন।

অগ্নিবীণার কবিতাগুলো নিয়ে কম কথা হয়নি। আকস্মিকভাবে উদিত এই কবির তুমুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর হয়েছিলেন সে সময়ের সাহিত্যিকেরা। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়েই অসংখ্য ব্যঙ্গকবিতা লেখা হয়েছে শনিবারের চিঠিসহ সে যুগের নানা পত্রিকায়। এটি ছিল নতুন কবিতার সঙ্গে পুরোনো কবিতার দ্বন্দ্বের জের।

অন্য আরেকটি দিক থেকেও অগ্নিবীণা ও নজরুলের সমালোচনা কম হয়নি। কাজী আবদুল ওদুদ অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের ইসলামি ঐতিহ্যনির্ভর সাতটি কবিতাকে ‘প্যান-ইসলামি চিন্তাধারার কবিতা’ বলে সমালোচনা করেন। পরে আরও অনেক গবেষক কবিতাগুলোকে ইসলামের প্রতি নজরুলের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু হিন্দু ঐতিহ্যনির্ভর কবিতাগুলো নিয়ে তাঁরা নীরব রইলেন। অনেক পরে এসে, ১৯৫০ সাল নাগাদ বিষয়টি লক্ষ করলেন কবি গোলাম মোস্তফা।

পাকিস্তানি আদর্শের খাপে পোরার জন্য তিনি নজরুলের ভাষা ও শব্দ ইত্যাদি ছাঁটাইয়ের কাজে নামলেন। ‘নজরুল কাব্যের অবাঞ্ছিত অংশ’ প্রবন্ধে তিনি বললেন, ‘ইহাতে মোট ১২টি কবিতা আছে...এর ভিতরে ৭টিই ইসলামী ভাবাপন্ন, বাকী ৫টি...ইসলাম ও পাকিস্তানী আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী। কাজেই আমাদের মতে এগুলি বর্জন করিতে হইবে।’ (বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল-জীবনী, গোলাম মুরশিদ, প্রথমা প্রকাশন)

অগ্নিবীণা কাব্যের এক শ বছর পরে এসে ওই সব একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে দেখলে বোঝা যায়, নজরুল সে সময়ের হিন্দু-মুসলমানের ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনের সম্ভাবনাকে জনমানুষের আরও জীবনের ভেতরে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। বাঙালি সমাজে শক্তির উদ্বোধনের জন্য হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্ম, পুরাণ ও ইতিহাস অকাতরে ব্যবহার করেছেন। নজরুল ছিলেন মিলনের কবি। কোনো ভেদ তিনি করেননি। এ কারণে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই নজরুল কাঙ্ক্ষিত একটি কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। এটিই নজরুল ও অগ্নিবীণার মূল শক্তি।

আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। জন্মদিনে কবিকে ভালোবাসা জানাই।