মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ

‘এ রকম অবস্থায় সেনাপ্রধান কী করতে পারেন?’

বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার সময়কালে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ। সে দিনের ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে মতিউর রহমান তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেন। ১৯৯৩ সালের ১৫ ও ১৬ আগস্ট সাক্ষাৎকারটি ভোরের কাগজ-এ ছাপা হয়। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: কে এম সফিউল্লাহ ও শাফায়াত জামিল বিতর্ক গ্রন্থ থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখাটি নেওয়া হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মতিউর রহমান

কে এম সফিউল্লাহ
প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে আপনি কখন জানতে পারলেন?

কে এম সফিউল্লাহ: ১৫ আগস্ট ভোরে ফজরের নামাজের পর আমি এ সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। সেদিন (১৪ আগস্ট) বিকেলে ওই মঞ্চে এবং এর আশপাশে কিছু বিস্ফোরণ ঘটে। আরও বিস্ফোরক আছে কি না, সেটা দেখার জন্য পুলিশের আইজি নূরুল ইসলাম আমাকে ওই এলাকাকে বিপদ–মুক্ত করার অনুরোধ জানান। সে জন্য বিস্ফোরক উদ্ধার বিশেষজ্ঞদের কয়েকটি দল পাঠাই। এসব নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত থাকি। এই সবকিছু শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সেদিন খুব সকালে— তখন হতে পারে ভোর সাড়ে পাঁচটা কি তারপর—সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. ক. সালাহউদ্দিন এসে আমাকে খবর দেয়, ‘স্যার, আপনি কি আর্মার্ড ও আর্টিলারি রেজিমেন্টকে শহরে পাঠিয়েছেন? তারা তো শহরে যাচ্ছে। তারা রেডিও অফিস দখল করেছে। তারা গণভবন, ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছে।’

এ কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার মধ্যে বিদ্যুতের মতো প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার জানেন?’ এরপর আমি তাকে বলি, ‘যদি তারা এভাবে গিয়ে থাকে, তাহলে তুমি তাড়াতাড়ি ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের কাছে যাও, ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়নকে প্রস্তুত করে প্রতিরোধ করতে বলো।’ 

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: এ ঘটনা জানার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কি আপনার কোনো যোগাযোগ হয়েছিল?

কে এম সফিউল্লাহ: লে. ক. সালাহউদ্দিনকে এই নির্দেশ দিয়ে ঘরে গিয়ে লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। দেখি, তাঁর টেলিফোন ব্যস্ত। তখন আমার স্ত্রীকে লাল টেলিফোন ঘোরাতে বলি, আর আমি অন্য টেলিফোনে চেষ্টা করি। এই সময়ের মধ্যে যদি বঙ্গবন্ধুও আমাকে চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তিনি আমাকে পাননি। আমি জানার পর যদি তিনি চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তো পাওয়ার কথা নয়; কারণ, আমার টেলিফোন তো তখন ব্যস্ত।

কয়েকটি টেলিফোন করার পর আমি আবার টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ছয়টা বাজার তিন-চার মিনিট আগে আমি টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে যাই। আমার সঙ্গে শুধু কয়েকটি কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মাইরা ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ আমি বলি, ‘স্যার, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস?’ আমি এ কথা বলার পর তাঁর গলা আমি আর শুনতে পাইনি। মনে হলো, টেলিফোনটি টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছেন। আমি হ্যালো হ্যালো করছি। সে সময়ই আমি টেলিফোনের মধ্য দিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এরপরই টেলিফোনটা অকেজো হয়ে যায়। 

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: আপনি কি কিছু করতে পেরেছিলেন? আপনার চেষ্টার ফল কী হলো?

কে এম সফিউল্লাহ: সিকোয়েন্সটা হলো এ রকম। আমি প্রথমে কথা বলি শাফায়াত জামিলের সঙ্গে। আমার মনে হলো আমি তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়েছি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি জানেন যে আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিট শহরের দিকে গেছে?’ তিনি বলেন, জানেন না। তখন আমি বললাম, ‘সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এসে আমাকে এ খবর দিয়েছে। আমি তাঁকে তখন প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ওই গ্রুপটিকে প্রতিরোধ করার জন্য নির্দেশ দিই। এ কথা বলে আমি বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার এবং নৌবাহিনীর প্রধান এম এইচ খানকে ফোন করি। কথা বলি। আমি বুঝলাম, তাঁরাও কিছু জানেন না। এরপর আমি জেনারেল জিয়ার সঙ্গে কথা বলি। আমার মনে হলো তিনি আমার কাছ থেকেই ঘটনা সম্পর্কে প্রথম শুনলেন। আমি তাঁকে বলি, ‘আপনি দ্রুত আমার বাসায় চলে আসুন।’ এরপর ফোন করি খালেদ মোশাররফকে। তাঁকেও আমার বাসায় আসতে বলি।

এরপর ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার রউফকে ফোন করি। তাঁর বাসায় কেউ ফোন ধরেননি। এরপর কর্নেল জামিলকে (নতুন ডিজি, ডিজিএফআই) ফোন করি। তাঁকে আমি পাই। তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকেছেন। আমি তাঁর বাসায় যাচ্ছি।’ আমি বলি, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। তুমি যেহেতু বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছ, তাঁকে বলো, আমি কিছু করার চেষ্টা করছি। আর যদি পারো, তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেয়ো।’ এসব কিছুর পর আমি বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পাই এবং কথা বলি। সে কথা আগেই বলেছি। 

এরপর আমি আবার ফোন করি কর্নেল শাফায়াত জামিলকে। কারণ, তখন পর্যন্ত কিছুটা সময় ছিল। ১৫-২০ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কোনো প্রতিক্রিয়া বা কোনো তৎপরতার খবর পাচ্ছিলাম না। এমনটা কেন হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি তাঁকে না পেয়ে এক্সচেঞ্জকে বললাম আমাকে ধরিয়ে দিতে। এক্সচেঞ্জ থেকে বলা হয়, মনে হয় টেলিফোনটা তুলে রাখা হয়েছে। আমি ভাবলাম, হয়তো উত্তেজনায় টেলিফোনটা তিনি ঠিক জায়গায় রাখতে পারেননি। অথবা যারা ক্যু করেছে, তারা তাঁকে আটকে রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে জেনারেল জিয়া চলে আসেন। খালেদও আসেন। এ সময় আমার বেটম্যান রেডিও খুলে দেয়। আমি ডালিমের গলা শুনতে পাই।

আমি তাঁদের বললাম, ‘শাফায়াত কী করছে?’ আমি বুঝতে পারছি না। আমি বাসায় বসে কিছু করতে পারছি না। আমি অফিসে যাব। আমি যখন কাপড় বদলাতে ভেতরে যাই, তখন দেখি রউফ আমার পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে এসে পড়েছে। সে তখন লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় ছিল। আমি ওকে বাসায় গিয়ে কাপড় বদলিয়ে আসতে বলি।

আমি প্রস্তুত হয়ে অফিশিয়াল গাড়িতে অফিসে যাই। জিয়া আমার পরপর আমার অফিসে আসেন। ইতিমধ্যে খালেদও চলে আসেন। আমি ওকে শাফায়াতের ব্রিগেডে যেতে বলি এবং কেন ওরা কিছু করছে না, সেটা জানাতে বলি। কোনো তৎপরতা দেখছি না কেন, ইতিমধ্যে তো দ্রুত তৎপরতা শুরু হওয়া উচিত ছিল।

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: আপনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর কখন জানলেন?

কে এম সফিউল্লাহ: এরপর আমার এডিসিকে খবর দিতে এবং আমাকে জানাতে বলি। তারপর আমি ঢাকার বাইরে অন্যান্য ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। ইতিমধ্যে তারা রেডিও থেকে খবর জেনে গেছে। আমি তাদের বলি, যা ঘটেছে, সেটা আমার অজ্ঞাতে হয়েছে। আমি ঢাকার কমান্ডারকে প্রতিরোধের জন্য বলেছি। পরবর্তী নির্দেশের জন্য আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলি। 

এরপর খালেদ মোশাররফ আমাকে টেলিফোন করে। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘কী হচ্ছে?’ সে তখন বলে, ‘স্যার, ওরা আপনাকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে চায়।’ আমি বলি, ‘ওরা কে?’ সে বলে, ‘আমাকে সব বলতে দিচ্ছে না।’ আমি বলি, ‘যাহোক তুমি আসো।’ সে বলে, ‘আমাকে ১৫ মিনিটের জন্য আসতে দিচ্ছে।’ আমি ওকে আসতে বলি।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এডিসি এসে বলে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এই প্রথম আমি শুনি এবং আমার মধ্যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয়। এ খবর আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। এডিসি চলে যাওয়ার পর খালেদ আসে। সে বলে, ‘বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। পুরো গ্যারিসন মনে করে আপনার নির্দেশে ক্যু হয়েছে।’ ওরা আনন্দ করছে। কেউ নড়ছে না। যখন খালেদ কথা বলছিল, তখন জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল নাসিম আমার অফিস কক্ষে ছিল।

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: আপনার সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের কখন কোথায় কথা হলো?

কে এম সফিউল্লাহ: সে সময় আমি ভাবছিলাম, আমার কী করা দরকার? আমার সামনে দুটি প্রশ্ন—এক. বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমার কোনো সংশয় থাকত না। আমি সরাসরি সংঘর্ষে যেতাম। দুই. যেহেতু বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই, তাই আমি সংঘর্ষে গিয়ে কী লাভ করতে পারব? পারি গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে। এতে আরও রক্তপাত হবে। এটা কি লাভজনক হবে? এ কথা ভাবতে ভাবতে ওরা চলে আসে। কিছু কথা হওয়ার পর সবাই আমরা রেডিও স্টেশনে চলে যাই।

সেখানে যাওয়ার পর খন্দকার মোশতাক যে ঘরে বসা ছিলেন, সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আমাকে বলেন, ‘অভিনন্দন সফিউল্লাহ, তোমার সৈন্যরা একটি বিরাট কাজ করেছে। এখন বাকিটা করো।’ আমি বললাম, ‘আর বাকি কী আছে?’ তিনি বলেন, ‘তোমারই সেটা জানার কথা।’ এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলি, ‘তাহলে সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দিন।’ এ কথা বলে চলে আসার সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খন্দকার মোশতাককে বলেন, ‘স্যার, ওনাকে থামতে বলুন। ওনাকে থাকতে হবে। রেডিওতে একটা ঘোষণা দিতে হবে।’ এবং আমাদের গতি রোধ করা হলো। সে সময় তাহের ঠাকুর একটা কাগজে ঘোষণা লিখে দিল। সেটা আমরা একে একে পড়ি। সেটাই পরে রেডিওতে ঘোষিত হয়।

এই সবকিছুর পর খন্দকার মোশতাক বলেন, ‘আমি এখনই বঙ্গভবনে যাচ্ছি। জুমার নামাজের আগেই সেখানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। আমি চাই, আমার সকল প্রধানেরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন।’ এরপর আমরা সবাই ক্যান্টনমেন্টে চলে আসি এবং সব অফিসারকে একত্র করে পুরো ঘটনা বর্ণনা করি। সবাইকে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বলি। তারপর বঙ্গভবনের দিকে চলে যাই। তখন প্রায় ১১টা বেজে গেছে। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। প্রধান বিচারপতি অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন। 

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারলেন না, এটা কি আপনার ব্যর্থতা বলে মনে করেন?

কে এম সফিউল্লাহ: প্রশ্ন হলো, এ রকম অবস্থায় একজন সেনাপ্রধান কী করতে পারেন? তিনি তো একজন একক ব্যক্তি। তিনি তাঁর সহকর্মী, অধীন অফিসারদের দিয়ে কাজ পরিচালনা করেন। সে সময় যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তিনি ছিলেন ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার। তাঁকে নিষ্ক্রিয় দেখে চিফ অব জেনারেল স্টাফকে পাঠালাম। তিনিও উৎসাহব্যঞ্জক রিপোর্ট দিলেন না। তখন আমি নিজে যাই এবং ৪৬ নম্বর ব্রিগেডে গিয়ে যখন দেখি, আমি একা, তখন আমার কী করণীয় থাকে? 

আমার মনে হয়, আমার যদি কোনো ব্যর্থতা থেকে থাকে, সেটা হলো আমার নিজের আত্মাহুতি প্রদান। এটাই যদি আমার কর্তব্য হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে আমি আমার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। সেটা করে যদি কোনো লাভ হতো, তাহলে সেটা আমার ব্যর্থতা।