দেড় দশকে দেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এই সভায় বক্তারা বলেন, আওয়ামী লীগ মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে কাছে টানার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত মতবিনিময় বিশিষ্টজনেরা। ঢাকা, ৩১ মে
ছবি: আশরাফুল আলম

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও গত দেড় দশকে দেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বদলানোর কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে অন্যান্য নির্বাচনের মতো আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। ‘জাতীয় নির্বাচন ২০২৪: ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার’ শীর্ষক এই সভা বুধবার বিকেলে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয়।

এতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে করা অঙ্গীকারগুলো পূরণের দাবি করা হয়। পরিষদের নেতারা বলেছেন, ইশতেহারে অঙ্গীকার করলেও আওয়ামী লীগ এসব প্রতিশ্রুতির একটিও পূরণ করেনি।

মতবিনিময় সভায় মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের শেষে এসে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অস্তিত্বের লড়াই করতে হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতা দূর করার চেষ্টা করেনি। তারা সমাজ বদলানোরও চেষ্টা করেনি। বরং আওয়ামী লীগ নিজেদের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশ আরও সাম্প্রদায়িক হয়ে যাওয়ার কথাটি বলেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার প্রায় পুরোটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সরকারের চলতি মেয়াদে অল্প যে সময় বাকি আছে, তাতে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে মিলে সামাজিক আন্দোলন করে দাবি পূরণ করাও সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিমধ্যে নানা মহল থেকে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত
রানা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

দেশ আরও সাম্প্রদায়িক হওয়াসংক্রান্ত দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। সভায় তিনি বলেন, দেশে সাম্প্রদায়িকতার একটা সামাজিকীকরণ হয়েছে। এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উৎসবের সময় হামলা হবে, এটাই যেন রীতি। হামলা কম হলে বলা হয় যে এবার কম হয়েছে। বাংলাদেশে আবার অসাম্প্রদায়িক হবে সেটা নিজের জীবদ্দশায় দেখে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি।

আগামী নির্বাচন ঘিরে প্রার্থীরা সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিলে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন যেন ব্যবস্থা নেয়, সেই দাবি জানান রামেন্দু মজুমদার।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিমধ্যে নানা মহল থেকে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। কারণ আমরা খেয়াল করেছি, নির্বাচনের পূর্বাপর ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মহল সহিংসতা চালায়।’ তিনি বলেন, একদিকে শঙ্কা, অন্যদিকে আজও দাবি পূরণ না হওয়ায় সংখ্যালঘু জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে, যা সামনের নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

রানা দাশগুপ্ত জানান, গত ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে এবং গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছে। সেখানে তাঁরা আওয়ামী লীগের ইশতেহারে করা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।

বিগত কয়েক দশকে সমাজে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি আক্রান্ত হলে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিবেশীও নীরব থাকে। আর রাজনীতিবিদেরা হয় সমঝোতা করেন, না হয় সামলে চলেন। রাজনীতিবিদেরা যখন সমঝোতা বা সামলে চলেন তখন নীতির পরাজয় ঘটে।

সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন সম্প্রীতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে যেগুলো সম্ভব সেগুলো আগামী নির্বাচনের আগে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করা আওয়ামী লীগের দায় বলে উল্লেখ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি এ–ও বলেন, সেখান থেকে আওয়ামী লীগ এখন অনেক দূরে সরে গেছে। এখন আওয়ামী লীগের বন্ধু হেফাজতে ইসলাম। দলটি বিভিন্ন মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হবে।

মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ঢাকা, ৩১ মে
ছবি: আশরাফুল আলম

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সবার একসঙ্গে দাঁড়ানো দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল। তিনি বলেন, ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের দাবি মেনে নেয়নি, আগামী দিনেও মেনে নেবে না। তবে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করতে পারলে যেকোনো সরকার তা মেনে নিতে বাধ্য হবে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে নিলে ভোট কমবে না বরং অপকর্ম করলে ভোট কমবে বলে মনে করেন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ভারতে সংখ্যালঘু কমিশন হয়েছে ৩০ বছর আগে। বাংলাদেশে আজও হলো না। একটি দেশ কতটা ভালো করছে, তা নির্ভর করে সংখ্যালঘুরা কেমন আছে তার ওপর।

মতবিনিময় সভার সভাপতিত্ব করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক। আরও বক্তব্য দেন বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদিকা মাসুদা রেহানা বেগম, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর প্রমুখ।

তানিয়া আমীর বলেন, রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে যে অঙ্গীকার করে ভোট নেয়, সেটা যদি পূরণ না করে, সেটা সামাজিক চুক্তির লঙ্ঘন।