কাগজে-কলমেই আটকে আছে ‘বিল্ডিং কোড’

অগ্নিকাণ্ড বা ভবন হেলে পড়ার ঘটনা ঘটলে বিল্ডিং কোড নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এটির প্রয়োগে উদ্যোগ কম।

ইমারত নির্মাণে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নকশা ও নির্মাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্ধারিত বিধি অনুসরণ করতে হয়প্রতীকী ছবি

বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ না থাকায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) কাগজে-কলমেই আটকে আছে। গেজেট হওয়ার সাড়ে তিন বছরেও সরকার এটির প্রয়োগ শুরু করেনি।

নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, বড় শহরের পাশাপাশি উপজেলা শহর, এমনকি গ্রামগঞ্জেও এখন উঁচু ভবন নির্মিত হচ্ছে। বিধিবিধান অনুসরণ না করায় অনেক ভবন হচ্ছে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো অগ্নিকাণ্ড বা ভবন হেলে পড়ার ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন মহল থেকে বিল্ডিং কোড নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এটি প্রয়োগে সরকারের উদ্যোগ দেখা যায় না। দ্রুত বিল্ডিং কোড প্রয়োগে কর্তৃপক্ষ গঠন করা না হলে এ ধরনের ভবনের সংখ্যা ও অগ্নিদুর্ঘটনার মতো ঝুঁকি বাড়বে।

ইমারত নির্মাণে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নকশা ও নির্মাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্ধারিত বিধি অনুসরণ করতে হয়। দেশে ১৯৯৩ সালে প্রথম বিল্ডিং কোড বা নির্মাণবিধি প্রণীত হয়। কিন্তু আইনি জটিলতায় ১৩ বছর এ বিধির গেজেট হয়নি। বিধিতে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ ছিল না।

২০০৯ সালে আগের বিধি সংশোধন করার কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে তা চূড়ান্ত হলেও এর গেজেট নোটিফিকেশন আটকে ছিল কয়েক বছর। অবশেষে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সংশোধিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০২০’ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এ নির্মাণবিধি শুধু ঢাকা নয়, বরং সারা দেশেই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাড়ে তিন বছর আগে সংশোধিত বিল্ডিং কোড করা হলেও এর সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। সারা দেশেই যত্রতত্র ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে। এই কোড বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ লাগবেই। শুধু বিল্ডিং কোড নয়, ভবন তৈরিতে ইমারত নির্মাণ ও পরিকল্পনাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনও মানা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করবে এই কর্তৃপক্ষ। এত দিনেও কর্তৃপক্ষ গঠিত না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।’

কীভাবে গঠিত হবে, কী কাজ করবে

নির্মাণবিধির প্রয়োগ ও তদারকিতে সরকার বাংলাদেশ ইমারত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি—বিবিআরএ) নামে নিয়ন্ত্রণ বা নীতিনির্ধারণী (রেগুলেটরি) একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ কর্তৃপক্ষ ওই বিধি কার্যকরের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। বিধির দ্বিতীয় অংশের ২ নম্বর অধ্যায়ে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।

ইমারত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হবে পাঁচ সদস্যের। তাঁদের মধ্যে একজন করে পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, পুরকৌশলী, আইনবিদ ও আমলা থাকবেন। প্রত্যেকে হবেন কমপক্ষে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সরকার তাঁদের তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেবে। সদস্যদের মধ্য থেকে একজন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হবেন। কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হবে ঢাকায়।

শুধু বিল্ডিং কোড নয়, ভবন তৈরিতে ইমারত নির্মাণ ও পরিকল্পনাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনও মানা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করবে এই কর্তৃপক্ষ। এত দিনেও কর্তৃপক্ষ গঠিত না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।
আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স 

নির্মাণবিধিতে কর্তৃপক্ষের ১৬ ধরনের কাজের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইমারতের নকশা ও নির্মাণসংক্রান্ত আইনি কাঠামো প্রস্তুত, বিধি অনুযায়ী ভবন অনুমোদন ও নির্মাণ তদারকির প্রক্রিয়া তৈরি, ভবন নির্মাণসম্পর্কিত পেশাজীবীদের জন্য নিবন্ধনের ব্যবস্থা, ভবন অনুমোদন ও দেখভালপ্রক্রিয়া হালনাগাদ করা এবং প্রয়োজন মোতাবেক বিধি সংশোধন।

মাঠপর্যায়ে নির্মাণবিধি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে। এর প্রধান হবেন বিল্ডিং অফিশিয়াল। একজন নগর-পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি বা পুরকৌশলীকে বিল্ডিং অফিশিয়াল হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হবে। মাঠপর্যায়ে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান সরকারি সংস্থাগুলো থেকেই বিল্ডিং অফিশিয়াল নিয়োগ করা হবে, যাঁরা বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কমিটির মাধ্যমে ইমারত নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিষয়াদি তদারক করবেন।

কর্তৃপক্ষ কবে হবে অনিশ্চিত

বর্তমানে যেসব ভবনের নকশা অনুমোদিত হয়, তাতে নির্মাণবিধি অনুসরণ করার শর্ত থাকে। কিন্তু প্রকৃতই তা করা হচ্ছে কি না, মাঠপর্যায়ে সেভাবে তদারক করা হয় না। এর ফলে কখনো অনুমোদিত তলার চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, কখনো অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও রাখা হচ্ছে না।

অনিয়মের মাধ্যমে নির্মিত ভবনের কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। যেমন ২০১৯ সালে রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন মারা যান। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। আগুনে পুড়ে যাওয়া আটতলা ভবনটির অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ ছিল না। রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমতি না থাকলেও ভবনের বেজমেন্ট (গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান) ছাড়া সব কটি তলায় ছিল রেস্তোরাঁ। দুর্ঘটনার পর ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের বিষয়টি আবারও সামনে আসে।

যত দিন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ কার্যক্রম শুরু না করবে, তত দিন এই বিল্ডিং কোড কাগজে-কলমেই থাকবে। বিল্ডিং কোডের বিধান অনুসরণ না করলে ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সংশোধিত বিল্ডিং কোডের গেজেট হতে অনেক সময় চলে গেছে, এখন কর্তৃপক্ষ তৈরিতে অযথা কালক্ষেপণ হলে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ

কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নবীরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নে সরকার একটি কমিটি করেছে। পদাধিকারবলে গণপূর্তসচিব কমিটির আহ্বায়ক। কমিটি এরই মধ্যে একাধিক সভা করেছে। কোড বাস্তবায়নে বিভিন্ন পক্ষ সম্পৃক্ত। কমিটি সবার মতামত নিচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ করার চেষ্টা হচ্ছে।

নির্মাণবিধি বাস্তবায়নে গত ডিসেম্বরে একটি কারিগরি সমন্বয় কমিটি গঠন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ‘বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি’ গঠনের আগপর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে এ কমিটি। ১৮ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক গণপূর্তসচিব এবং সদস্যসচিব গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। বিধি কার্যকর করার লক্ষ্যে কমিটি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে।

তবে বিল্ডিং কোড প্রয়োগে সরকার এখনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যত দিন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ কার্যক্রম শুরু না করবে, তত দিন এই বিল্ডিং কোড কাগজে-কলমেই থাকবে। বিল্ডিং কোডের বিধান অনুসরণ না করলে ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সংশোধিত বিল্ডিং কোডের গেজেট হতে অনেক সময় চলে গেছে, এখন কর্তৃপক্ষ তৈরিতে অযথা কালক্ষেপণ হলে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।