দুর্নীতি ক্যানসারের মতো কাজ করছে সর্বত্র: নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান
ছবি: সংগৃহীত

প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, দুর্নীতি একটি ক্যানসারের মতো কাজ করছে সর্বত্র। এটি এমন নয় যে শুধু বিচার বিভাগেই আছে, এমন নয় যে এটি শুধু অন্য কোনো বিভাগে আছে—এটি সব জায়গাতেই কিছু না কিছু আছে। দুর্নীতি কমানোর ইচ্ছা থাকলে এটি কিছু না কিছু কমানো যাবেই।

আজ বুধবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এসব কথা বলেন। সামাজিক পরিবর্তন না আনলে শুধু বিচার করে, শুধু আইন-আদালত করে এই সমাজকে সঠিক পথে আনতে পারবেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি।  

বিচার বিভাগ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এমনটি মনে করেন না ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে সদ্য নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বিচারকেরা বিচারকের কাজ করে যাচ্ছেন তাঁদের মতো করেই। আমি শুধু একটি কথা বলব, যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বা যেসব আইনজীবী বন্ধু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তাঁরা রাজনীতিটা করুন। কিন্তু কোর্টের মধ্যে, আদালতে তাঁরা যেন সহনশীলতার পরিচয় দেন। তাঁরা যেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।’

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে গতকাল প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর শপথ গ্রহণের দিন থেকে এই নিয়োগ কার্যকর হবে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৫ সেপ্টেম্বর। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে আজ সকালে আপিল বিভাগে তাঁর কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা দেখা করতে যান। এ সময় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মামলাজট, মামলাজট নিরসনে করণীয়, বিচারপ্রার্থী ও বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা নিয়ে কথা বলেন।  

মামলাজট একটি পুরোনো ব্যাধি
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমাদের মামলাজট বা মামলার দীর্ঘসূত্রতা, এটি একটি পুরোনো ব্যাধি। এই ব্যাধি যাতে ক্রোনিক (দীর্ঘস্থায়ী) না হয়ে যায়, সেই চেষ্টা করব আমি।’ শপথ নেওয়ার পর এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি পূর্বসূরিদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করার কথাও বলেন তিনি।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘চেষ্টা করব, এই বিচার বিভাগকে আরও একটু গতিশীল করা যায় কি না। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ এবং অধস্তন আদালতে আমাদের যেসব সহকর্মী আছেন, সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, তাঁরা প্রত্যেকেই যেন এই বিচার বিভাগের কাজটি, বিচারের কাজটি নিজের কাজ মনে করেন। সেটি মনে করলেই শুধু সম্ভব হবে। যে পাঁচটি মামলা আমরা নিষ্পত্তি করতে পারি, এটি নিজের কাজ মনে করে করলে পাঁচ থেকে সাতটি হবে। নিষ্পত্তির সংখ্যাটা যদি আমরা বৃদ্ধি করতে পারি, তাহলে মামলাজট অনেকাংশেই কমে যাবে। আশা করি সেটি কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।’

শুধু বিচারকদের দিয়েই বিচার বিভাগ নয়, উল্লেখ করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন আইনজীবীরা, তাঁদের সহকারীরা ও অধস্তন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আরও অন্য স্টাফ যাঁরা, সবাই। সবাই যদি আন্তরিক হন, তাহলে বিচারপ্রার্থী মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।’

মামলাজট বিষয়টি নতুন নয় উল্লেখ করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এটি অনেক পুরোনো। তাঁর কাছে ময়মনসিংহ জেলা আদালত থেকে একটি রায়ের কপি দেওয়া হয়েছে জাদুঘরে রাখার জন্য। এটি ১৮৬১ সালের রায়। মামলাটি শুরু হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। তখনো একটি মামলা মুনসেফ কোর্টে শেষ হতে চার-পাঁচ বছর লেগেছে। এখানে আমার মনে হয়, আইনের সংস্কার একটি বড় বিষয়। আইনি সংস্কারটি সরকার নিশ্চয় চিন্তা করবে।’

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) এবং মেডিয়েশনের (মধ্যস্থতা) মাধ্যমে অনেক মামলা কমতে পারে বলে মনে করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, ‘তাঁরা (বিচারপ্রার্থী) ঘরে বসে বিচারালয়ে না গিয়ে একই রকম ফল অন্যভাবে পেতে পারেন এডিআর, মধ্যস্থতা ও সালিসের মাধ্যমে। এগুলো বাংলাদেশে ডেভেলপ করছে ধীরে ধীরে। চেষ্টা করবেন, সবাই মিলে এটি আরও গতিশীল করতে, যাতে মানুষকে আদালতমুখী খুব একটা না হতে হয়।’  

মামলাজট কমানো বড় চ্যালেঞ্জ
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘মামলাজট কমানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটি বিষয় আপনাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, সারা বাংলাদেশে আছে—সেটি দুর্নীতি। দুর্নীতি একটি ক্যানসারের মতো কাজ করছে সর্বত্রই। আমার পূর্বসূরিরা যেভাবে চেষ্টা করেছেন, আমি চেষ্টা করব সহকর্মীদের নিয়ে একইভাবে এই দুর্নীতি যাতে কমানো যায়, সে উদ্যোগ নিতে।’

আস্থা আছে বলেই মানুষ আদালতে আসেন
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আস্থার ঘাটতি সর্বত্রই আছে। বিচার বিভাগের ওপর আস্থার ঘাটতি নেই, এ কথা আমি বলব না। মামলা নিষ্পত্তির হার দিনের পর দিন বাড়ছে। মানুষের যদি আস্থাই না থাকবে, মানুষ কোর্টে আসবেন কেন? আস্থা আছে বলেই মানুষ কোর্টে আসেন। আস্থা শতভাগ আছে, এ কথা আমি বলতে পারব না। আস্থা নেই, এ কথা বলতে আমি রাজি নই, আস্থা আছে। আস্থার হয়তো কিছু কমতি আছে। ধীরে ধীরে আমাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সহযোগিতা নিয়ে এই আস্থা বাড়াতে চেষ্টা করব।’