ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে আয়োজিত ‘তৃণমূল মানুষের কথা: স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। ঢাকা, ২৩ জুলাই
ছবি: সংগৃহীত

নারীর স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নারীদের মধ্যে জরায়ু ও প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ বেশি দেখেছেন গবেষকেরা। গবেষকেরা বলছেন,  উপকূলবর্তী এলাকার নারীদের মাসিক নিয়মিতকরণে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে।

রোববার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে আয়োজিত ‘তৃণমূল মানুষের কথা: স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ। গবেষণাটি করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমিনেন্স।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং পরিবেশ ও জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের গাবুরা এলাকার পানির লবণাক্ততা এবং সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা একই মাত্রার। লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নারীর স্বাস্থ্যে, তাঁদের মাসিক চক্রে গোলমাল দেখা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিকাশমান এবং রাজনৈতিক বিষয় মন্তব্য করে আইনুন নিশাত বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে ধারণার স্পষ্টতার ঘাটতি রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শ্রমিকের কর্মক্ষমতা প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্র দেশের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এসবের কী প্রভাব মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে, তা আরও গভীরভাবে তলিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে।

গবেষণায় কী পাওয়া গেছে
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন এমিনেন্সের একাধিক গবেষক। এমিনেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, সাতক্ষীরা এলাকার দরিদ্র নারীদের একটি অংশ জরায়ু ও অন্যান্য প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণে ভুগছেন। এর কারণ হচ্ছে, ওই সব নারী কোমরপানিতে নেমে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ধরে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করেন। মাসিক নিয়মিত করার জন্য নারীরা, এমনকি কম বয়সী মেয়েরা নিয়মিতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খান দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা না জেনেই। চর ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীরা সহজে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও প্রজননস্বাস্থ্য সেবা পান না।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, নেত্রকোনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, বরগুনা ও সাতক্ষীরা—আট বিভাগের আটটি জেলার দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি জানার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য জনবল কী অবস্থায় আছে, তা জানার চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা। এ বছর ৩ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গবেষকেরা একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করেন।

* স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অ্যাসবেসটস ব্যবহার করা হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে।
* লবণাক্ত এলাকায় ওআরএস কার্যকর কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
* জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ বাড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামে ও দুর্গম এলাকায় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কম, কেনার সামর্থ্য থাকলেও সহজে ওষুধ পাওয়া যায় না। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ত্বকের রোগ বেশি। খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যহানির কারণে দরিদ্র শ্রেণিতে অপুষ্টি বাড়ছে।

গবেষণার ওপর নির্ধারিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি-বিশেষজ্ঞ ওয়ামেক এ রাজা। তিনি বলেন, বর্তমান জলবায়ু এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত। বড় বড় প্রকল্প, যানবাহন ও যানজট এবং ঢাকার চারপাশের ইটভাটা রাজধানীর পরিবেশদূষণের প্রধান কারণ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ বাড়ছে।

ঘরের চালে অ্যাসবেসটস
অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্যসচিব গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, বজ্রপাতে আহত হওয়ার পর যাঁরা প্রাণে বেঁচে যান, তাঁদের জন্য কোনো চিকিৎসাবিধি (ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল) দেশে নেই। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মাসিক নিয়মিত করার জন্য নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ানো হয়, নাকি অন্য কিছু খাওয়ানো হয়, তা অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঘরের চালে টিন ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। কারণ, লবণাক্ততার কারণে টিনে সহজে মরিচা ধরে যায়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি ধরার জন্য ঘরের চালে টিনের পরিবর্তে অ্যাসবেসটস ব্যবহার করছে। অ্যাসবেসটস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে পৃথিবীর অনেক দেশে নিষিদ্ধ। তিনি আরও বলেন, ওআরএস বা প্যাকেটজাত মুখে খাওয়ার স্যালাইন দক্ষিণাঞ্চলে কার্যকর নয়।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক আহমেদ মোস্তাক রাজা চৌধুরী বলেন, ওআরএস দক্ষিণাঞ্চলে সঠিক মাত্রায় কার্যকর কি না, এই প্রশ্ন গত শতকের আশির দশকেও উঠেছিল। তখন বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, তা কার্যকর। এখন যেহেতু প্রশ্নটা উঠেছে, সুতরাং এর বৈজ্ঞানিক মীমাংসা দরকার।

গবেষক দলের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, লবণাক্ততার কারণে হওয়া ত্বকের রোগ, ডায়রিয়া, টাইফয়েড শনাক্ত করা ও চিকিৎসা উন্নতি করতে হবে; ওই সব এলাকায় দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে এবং স্বাস্থ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ে গণমাধ্যমের সচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল।