রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শ্লথ করেছে: রাষ্ট্রপতি

চলতি বছরের প্রথম ও একাদশ জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশনে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ
ছবি: পিআইডি

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ আমরা অতিবাহিত করছি। ২০২২ সাল আমাদের জন্য ছিল চ্যালেঞ্জের একটি বছর। সমগ্র বিশ্বই পার করছে এক কঠিন সময়।’

আজ বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদে নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে (চলতি সংসদের ২১তম অধিবেশন) দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। তিনি দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

বিকেল চারটায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার বিধান আছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ১৬৮ পৃষ্ঠার ভাষণের সংক্ষিপ্তসার অধিবেশনে পড়েন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর একটি ধন্যবাদ প্রস্তাব আনা হয়। অধিবেশনজুড়ে ওই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করবেন সংসদ সদস্যরা।

বিভিন্ন বড় প্রকল্প, অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য, কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে নেওয়া সরকারের উদ্যোগ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা ভাষণে তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘করোনা অতিমারি আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে। তারপরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।’

রাষ্ট্রপতি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিবাচক। মাথাপিছু জাতীয় আয় আগের অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে।

করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় সরকারের দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, এসব প্যাকেজের কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।

সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে মাস্টারপ্ল্যান, আইন, নীতিমালা ও স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসাবে ছয়টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম মেট্রোরেল চালু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, সরকারের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি এমআরটির মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বাংলাদেশের সক্ষমতা ও গর্বের প্রতীক পদ্মা সেতু গত ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে দেশের তিন কোটিরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবেন। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুলেন টানেলের দক্ষিণ টিউবের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। দ্রুতই টানেলটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে।

জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস এবং জাতীয় সংসদকে প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু উল্লেখ করে সংসদ সদস্যের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আপনারা জনপ্রতিনিধি, তাই জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’

রাষ্ট্রপতি বলেন, এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও একজন দিনমজুরের বেতন দিনে কমপক্ষে ৭০০ টাকা। একই সঙ্গে বেড়েছে জাতীয় উৎপাদন। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ১৪ লাখ মেট্রিক টন, যা সন্তোষজনক। এ ছাড়া এবার দেশব্যাপী আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন জোরদার করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বাজেট বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যার পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। বর্তমানে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৭ লাখ, বিধবা ও স্বামী–নিগৃহীত নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তির উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ এবং প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ৬০ বছরের উর্ধ্বে দেশের সব নাগরিকের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার।

রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’—এই নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে।