সুলতানা’স ড্রিম নারীকে এখনো পথ দেখাচ্ছে

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘মাই এনকাউন্টার উইথ রোকেয়া’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন খ্যাতিমান স্প্যানিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ইসাবেল হারগুয়েরা। গতকাল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

সময়টা ২০১১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। ভারতের গোয়ায় এইচআইভি (এইডস) আক্রান্ত শিশুদের ওপর স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষে দিল্লিতে অবস্থান করছি। একদিন বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় নিলাম একটা গ্যালারিতে। সেখানে লোকশিল্পের ওপর প্রদর্শনী হচ্ছিল। সে প্রদর্শনীতে চোখে পড়ল লাল মলাটের একটা বই। প্রচ্ছদে একজন নারীর মহাকাশযান চালিয়ে নেওয়ার ছবি। চমকে উঠলাম! নিচে লেখা ‘সুলতানা’স ড্রিম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ১৯০৫। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম এটার ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করব। সুলতানা’স ড্রিম এখনো নারীর ভাবনাকে নীরবে পথ দেখাচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার ‘মাই এনকাউন্টার উইথ রোকেয়া’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বেগম রোকেয়ার লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রেক্ষাপট এভাবেই তুলে ধরেন খ্যাতিমান স্প্যানিশ চলচ্চিত্রনির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ওই বক্তৃতার আয়োজন করা হয়।

ইসাবেল হারগুয়েরা ২০২৩ সালে সুলতানা’স ড্রিম উপন্যাস অবলম্বনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করেছেন। ফিল্মটি এ পর্যন্ত ২০টি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, গোয়া অ্যাওয়ার্ড, অ্যাওয়ার্ড ফ্রম সান সেবাস্তিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ফিল্মফেস্ট হামবুর্গ, লিডস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।

৭ ডিসেম্বর ইসাবেল হারগুয়েরা বাংলাদেশে এসেছেন। আগামী শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আরেকটি অনুষ্ঠানে এই ফিল্মের আদ্যোপান্ত তুলে ধরবেন তিনি।

ইসাবেল হারগুয়েরা বলেন, শত বছর আগে বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির যে মশাল জ্বালিয়েছিলেন, সেটা এখন বিশ্বব্যাপী আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০১১ সালের দিকে বেগম রোকেয়ার কিছু লেখার অনুবাদ পাওয়া যেত। এখন ২০২৫ সালে বেগম রোকেয়ার অনেক কাজ অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে গত বছর।

বেগম রোকেয়া

বেগম রোকেয়ার লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটার মুহূর্তের কথা উল্লেখ করে ইসাবেল হারগুয়েরা বলেন, ‘সুলতানা’স ড্রিম বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেই থেমে গেলাম। বইয়ের পেছনে লেখা “একশ বছরের বেশি আগে লেখা নারীবাদী ইউটোপিয়া”—এই বাক্যটা আমাকে চমকে দিল! একই সঙ্গে মলাটের ছবিটা ছিল মুগ্ধ করার মতো।’ তিনি বলেন, ‘আমি বইটা উল্টে পেছনের লেখা দেখলাম। সেখানে বলা ছিল—বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এক স্বপ্নলোক বর্ণনা করেছেন। যেখানে নারীরাই জ্ঞানী, ক্ষমতাবান; তারাই বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি—সবকিছু পরিচালনা করছে। আর পুরুষেরা অশিক্ষিত, বাড়ির ভেতর থাকে, ঘর-গৃহস্থালির কাজ করে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বইয়ের ওপর আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করব।’

ইসাবেল হারগুয়েরার সঙ্গে বাংলাদেশ ভ্রমণ করছেন তাঁর জীবনসঙ্গী জনমারাকো সেররা, যিনি ইসাবেলের সঙ্গে এই চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত ছিলেন।

চলচ্চিত্রটিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এই ফিল্ম নারীর ইউটোপিয়া নিয়ে। আমার এক বন্ধু দারুণ একটা কথা বলেছিলেন, ইউটোপিয়া মানে ক্রিয়া (ব্যাকরণগত দিক দিয়ে)। ইউটোপিয়া এমন কিছু, যা আমাদের দেওয়া হয় না, কিন্তু আমরা সেটা নির্মাণ করি।’

খ্যাতিমান এই শিল্পী উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার অনুরোধে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ গানটি পরিবেশন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যশোর রোড ধরে ভারতীয় শরণার্থীশিবিরের দিকে যে জনস্রোত তৈরি হয়েছিল, সেটাকে উপজীব্য করে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ শীর্ষক কবিতা লিখেছিলেন। পরে সেই কবিতায় সুর দেন মৌসুমী ভৌমিক।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের গর্ব হয়, আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে ইউনেসকোর কাছে সুলতানা’স ড্রিমকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছিলাম। ২০২৪ সালে ইউনেসকো সেটার স্বীকৃতি দিয়েছিল।’

মফিদুল হক বলেন, এর পর থেকে সুলতানা’র ড্রিম-এর টেক্সট প্রচার করতে আমরা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছি। এ উপন্যাসের টেক্সট সমসাময়িক বাস্তবতায় এখনো প্রাসঙ্গিক।

অনুষ্ঠানে ফিচার ফিল্মটির অংশবিশেষ দর্শকদের দেখানো হয়। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এই ফিল্মের প্রযোজক দিয়েগো হারগুয়েরা ও চলচ্চিত্র দলের সদস্য রাকেল গালভেজ।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের গবেষণা সহযোগী তাবাসসুম নিগার।