বাল্যবিবাহ বন্ধে নজর দিন চর-হাওরে

মো. মোকতার হোসেন, আয়শা সিদ্দিকী, শাহনাজ এ জাকারিয়া, রমেশ সিং

বিশ্বে বাল্যবিবাহের হারে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দেশের হাওর ও চরাঞ্চলের মতো অনগ্রসর এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। বাল্যবিবাহ নিরোধে সরকারের করা জাতীয় কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নের গতি ধীর। ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ বন্ধে ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিবিদ, নিকাহ নিবন্ধক, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘চর ও হাওরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের বিদ্যমান অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো ও কেয়ার বাংলাদেশের সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচি। আয়োজনে সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি।

বৈঠকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মো. মোকতার হোসেন বলেন, এখনো নিবন্ধন ছাড়া বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে নিবন্ধন না হলে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক রয়েছে। যেসব পরিবার জলবায়ু অভিবাসী, সেখানে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনের তথ্য যাচাইয়ে একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) আয়শা সিদ্দিকী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করছে। হাওর ও চরাঞ্চলের কন্যাশিশুদের অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি এসব সহায়তা পেতে মেয়েশিশুকে স্কুলে পাঠাবেন এবং বিয়ে দেবেন না—এই অঙ্গীকারনামা দিতে হয়।

বাল্যবিবাহের বিষয়টিকে দীর্ঘদিনের সমস্যা বলে উল্লেখ করেন ইউএসএআইডির হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স অফিসের সিনিয়র অ্যাডভাইজার শাহনাজ এ জাকারিয়া। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ নিয়ে আগের চেয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। কারও একার পক্ষে বাল্যবিবাহ ঠেকানো সম্ভব না, সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রমেশ সিং বলেন, বাল্যবিবাহ ঠেকাতে এখন যেসব কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আরও আগেই নেওয়া প্রয়োজন ছিল। মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেলে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে দেশ, সমাজ ও পরিবারই বেশি উপকৃত হয়। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সূচনা বক্তব্যে কেয়ার বাংলাদেশের সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচির চিফ অব পার্টি মার্ক নসবাহ বলেন, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া নিয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা বদলাতে কাজ করছে কেয়ার বাংলাদেশ। বাল্যবিবাহ বন্ধে ধর্মীয় নেতা ও অভিভাবকদের ভূমিকা বেশি।

বৈঠকে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন কেয়ার বাংলাদেশের সৌহার্দ্য-৩ কর্মসূচির ওমেন এমপাওয়ারমেন্টের অ্যাডভাইজার সৈয়দা আশরাফিজ জাহারিয়া প্রধান। তিনি বলেন, স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোর কারণে নিকাহ নিবন্ধকেরা অনেক সময় বিয়ে পড়াতে বাধ্য হন। বাল্যবিবাহ ঠেকাতে ধর্মীয় নেতাদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা ভাবতে হবে। মেয়েদের শিক্ষিত করলে কী উপকার, তা অভিভাবকদের বোঝাতে হবে।

বাল্যবিবাহ বন্ধে ধারণাপত্রে বেশি কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে বিয়ের আগে পাত্রীর বয়স নিশ্চিত হতে দুই ধাপের যাচাইপ্রক্রিয়া চালু করা, বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন, কিশোরীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, স্কুল কর্তৃপক্ষ, নিকাহ নিবন্ধকদের প্রশিক্ষণ ও অনলাইনে জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র পরীক্ষার বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, তা বাড়ানো, স্থানীয়ভাবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো এবং মেয়েদের নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে তোলা অন্যতম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, হাওর ও চর এলাকায় মেয়েদের জন্য সুযোগ কম, অসুবিধা বেশি। যেসব এলাকায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে, যাঁরা বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন তাঁদের নিয়ে আলোচনা হওয়া বেশি প্রয়োজন।

শুধু জন্মনিবন্ধন যাচাই করলেই বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে না বলে মনে করেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর আলী আসগর। তিনি বলেন, ১৮ বছর না হলে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায় না, তাই বিয়ের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সামাজিক পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো অব প্র্যাকটিস মাহীন সুলতান। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কারণে বাল্যবিবাহ হয়, এটি একটি অজুহাত। কারণ, মেয়ের বিয়ে দিতে উল্টো ঋণ করতে দেখা যায়। এ অবস্থা বদলাতে সরকার ও সমাজের ভূমিকা লাগবে।

বাল্যবিবাহ দিতে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও গণমান্য ব্যক্তিরাও চাপ প্রয়োগ করেন বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, অনলাইনে কীভাবে জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করা যায়, সে বিষয়ে নিকাহ নিবন্ধকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

উন্নয়ন সহযোগীরা যা বললেন

ইউনিসেফ বাংলাদেশের জেন্ডার ফোকাল পয়েন্ট তাহমিনা হক বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধে নেওয়া জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় সরকারের ২৪টি মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন কম। বাল্যবিবাহ বন্ধে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের উপপরিচালক (অ্যাডভোকেসি) নিশাত সুলতানা বলেন, বাল্যবিবাহের পেছনে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ সদস্যরা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন। এ জনগোষ্ঠীর মনোজগতের পরিবর্তনে কাজ করতে হবে।

কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টিতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের জেন্ডার কো-অর্ডিনেটর মৌসুমী শারমিন।

বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।