সংঘাতে চোখে গুলি
‘নতুন বাংলাদেশ নিজের চোখে দেখা হলো না’
১৭ থেকে ২২ জুলাই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৪২৪ জন।
১৮ থেকে ২০ জুলাই দেড় শতাধিক ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছিলেন আগারগাঁওয়ের লায়ন চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৪৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর শয্যা। দুটি চোখেই গুলির ক্ষত নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন ওমর ফারুক (২০)। পাশে প্লাস্টিকের টুলে বসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন বোন রুমি আক্তার। অপর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফারুকের ছোট ভাই ফরহাদ হোসেন ও চাচা শামীম ইসলাম।
গত শনিবার দুপুরে ওমর ফারুকের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর (ফারুক) চোখে কটি গুলি লেগেছে? চিকিৎসকেরা কী বলছেন?’ তখন ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ধরে সবাইকে চুপ থাকার ইশারা করলেন ভাই ফরহাদ। ইশারায় এই প্রতিবেদককে ওয়ার্ডের বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন।
৪, ৫ ও ৬ আগস্ট চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছিলেন ২৬১ জন।
বাইরে এসে বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ নিজের চোখে দেখা হলো না, ভাইয়ার। তাঁর বাঁ চোখে সাতটি আর ডান চোখে চারটি গুলি লেগেছে। দুইটা চোখই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ডাক্তাররা বলেছেন তাঁর দুটি চোখেই দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।’ তাঁর ভাইকে এসবের কিছুই জানানো হয়নি বলেও জানালেন ফরহাদ।
ফারুক বগুড়া সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৪ আগস্ট দেশজুড়ে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির ডাক দেয়। ওই দিন বিকেলে কর্মসূচি চলাকালে বগুড়ার সাতমাথায় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সেখানে ফারুকের দুই চোখেই ছররা গুলি লাগে। পরদিন ফারুককে আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়।
তিন দিনে ১৮১ জনের চোখে অস্ত্রোপচার
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হিসাবে, সরকারের পদত্যাগের এক দফার দাবির আন্দোলন ও পরবর্তী সহিংসতায় তিন দিনে (৪, ৫ ও ৬ আগস্ট) সারা দেশ থেকে চোখে গুরুতর আঘাত নিয়ে ২৬১ জন এই হাসপাতালে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ভর্তি করা হয় ২৩৪ জনকে। আর চোখে অস্ত্রোপচার করা হয় ১৮১ জনের। গত শনিবার পর্যন্ত ২৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ভর্তি রোগীদের চোখে আঘাতের কারণ হিসেবে গুলি বা ‘গানশট’ লেখা রয়েছে।
চিকিৎসকেরা জানান, দুই চোখে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের চোখের দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তাঁরা হয়তো বাকি জীবন আর চোখে দেখতেই পাবেন না। চারজনসহ দুই চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৯ জন। এ ছাড়া ডান চোখে গুলির আঘাত নিয়ে ১০ জন এবং বাঁ চোখে গুলির আঘাত নিয়ে ৭ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
উভয় চোখেই দৃষ্টি ফিরে আসার সম্ভাবনা যে চারজনের নেই, তাঁরা হলেন ওমর ফারুক (২০), মারুফ হাসান (২২), সাব্বির আহমেদ (২৪) ও মো. ফারুক (৩৪)। এর মধ্যে মো. ফারুক বাদে বাকি তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। প্রথম দুজন শিক্ষার্থী, তৃতীয়জন পড়াশোনা শেষে একটি চাকরি করছিলেন।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক জামাল মোস্তাফা প্রথম আলোকে বলেন, গুলিতে ওমর ফারুক, সাব্বির আহমেদ ও মো. ফারুকের উভয় চোখই ফেটে গেছে। এর মধ্যে সাব্বিরের চোখ বাইরে বের হয়ে এসেছিল। আর মারুফ হাসানের মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত চোখের নার্ভ ও রেটিনা নষ্ট হয়ে গেছে। ওই চারজনের চোখে আর আলোর উপলব্ধি নেই।
এর আগে গত ১৭ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চোখে আঘাত নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৪২৪ জন। আর আগারগাঁওয়ের লায়ন চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১৮ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত দেড় শতাধিক আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২০ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। দৃষ্টি হারানোর শঙ্কা ছিল চারজনের।
সাব্বিরের চোখে গুলি লাগে কারওয়ান বাজারে
হাসপাতালের ৪১৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাব্বির আহমেদ। ৪ আগস্ট বিকেলে কারওয়ান বাজার এলাকায় তিনি চোখে গুলিবিদ্ধ হন। গত বছর রাজধানীর আহ্ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপণন বিভাগে চাকরি নিয়েছিলেন। থাকেন মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেট এলাকায়।
সাব্বিরের চোখ দুটি তুলা দিয়ে মুড়িয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। গুলি লাগার পর তাঁর চোখ দুটি বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছিল বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার সরকার।
সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড্ডা এলাকা থেকে আমরা মিছিল নিয়ে বাংলামোটর হয়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছিলাম। বাংলামোটরে গিয়ে জানতে পারি, কারওয়ান বাজারের দিকে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ছেলেরা শিক্ষার্থীদের গুলি করছে। পরে আমরা এক দল কারওয়ান বাজারের দিকে যাই। বেলা সোয়া তিনটার পরে পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। বিকেল পাঁচটার পর আমার চোখে গুলি লাগে।’
গুলিতে চোখের নার্ভ ছিঁড়ে গেছে
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের বেলকুচি সরকারি ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষার্থী মারুফ হাসান। ৪ আগস্ট সকালে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করার সময় তাঁর বাঁ চোখে ছররা গুলি লাগে। অস্ত্রোপচার করে ওই চোখ থেকে চারটি ছররা গুলি বের করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মারুফের চোখের যে নার্ভ মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত থাকে, সেই নার্ভ ছিঁড়ে গেছে। তাঁর বাঁ চোখে গুলি লেগেছে। ডান চোখেও এর প্রভাব পড়ছে।
হাসপাতালে মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এনায়েতপুরের কেজির মোড় এলাকায় মিছিল করছিলাম। মিছিল নিয়ে সবাই এনায়েতপুর থানার দিকে যাই। কিন্তু থানার আগেই মোড়ে থাকা পুলিশরা আক্রমণ করে। মিছিলের একদম শুরুতেই আমি ছিলাম। সেখানেই চোখে গুলি লাগে।’