সাক্ষাৎকার: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

এত বিস্ময়কর, এত স্বপ্নে ভরা পৃথিবী! এখানে আমি জন্মেছি

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন ২৫ জুলাই। ২০২৫-এ তিনি ৮৬ বছর পূর্ণ করছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষক, কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, টেলিভিশন-উপস্থাপক, পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক—অনেক পরিচয় তাঁর। পেয়েছেন র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ক্রাউন সিমেন্টের সহযোগিতায় প্রথম আলোর আয়োজনে ‘অভিজ্ঞতার আলো’ নামের ভিডিও সাক্ষাৎকারের অনুষ্ঠানে সম্প্রতি তিনি অতিথি হয়ে এসেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক। সাক্ষাৎকারটির শ্রুতলিখন নিচে তুলে ধরা হলো।

আনিসুল হক:

স্যার, আপনার শরীরটা কেমন আছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি এক সুন্দরীকে দেখেছিলাম! তিনি ক্ষণে হাসেন, ক্ষণে কাঁদেন! আমাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা তাই—এই ভালো তো এই খারাপ। এই রোদ, এই বৃষ্টি।

আনিসুল হক:

উইকিপিডিয়ায় লেখা যে আপনি ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন, ২৫ জুলাই। একটু আগে আপনার মুখে শুনলাম, আপনি আসলে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। সে হিসাবে আপনার বয়স ৮৬ বছর। আপনি বলছিলেন যে আপনি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি বছর বাঁচলেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ থাকলে তো আমি তাঁকে ধমক দিতাম। জুনিয়র তো।

আনিসুল হক:

স্যার, আপনার তো জন্ম হলো কলকাতায়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

আপনি কলকাতা থেকে এই পূর্ববঙ্গে কত বছর বয়সে এসেছিলেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: একেবারেই শৈশবে এসেছিলাম।

আনিসুল হক:

কলকাতার কোনো স্মৃতি নেই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমার আব্বা চাকরি করতেন করটিয়া কলেজে। কেমন? যখন আমি হব, সেই সময় আমার নানি এসে মাকে তাঁর কাছে নিয়ে যান। সেই জন্য একেবারেই কাকতালীয়ভাবে আমার জন্ম হয়ে গেল কলকাতায়।

আনিসুল হক:

আসলে আপনি পূর্ববঙ্গের মানুষ।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি পুরোপুরি পূর্ববঙ্গের মানুষ।

আনিসুল হক:

আপনার দাদাবাড়ি আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলে উপকূলে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: দক্ষিণ অঞ্চলে আমার বাড়ি। আমরা আগে বলতাম খুলনা, এখন বলি বাগেরহাট।

আনিসুল হক:

বাগেরহাট কথাটা কোথা থেকে এসেছে? বাঘ থেকে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, এটা বাগ।

আনিসুল হক:

বাগান!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাগ। সেদিন একটা জায়গায় গিয়েছিলাম, শ্রীপুরে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, একটা জায়গার নাম বাঘের বাজার।

আনিসুল হক:

বাঘের বাজার!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তখন মনে হলো এটা কেবল বাগ নয়, এটা একেবারে সত্যিকারের বাঘ। তবে আমাদের দেশে সব সময় বাঘ ছিল। সুন্দরবনের আশপাশে সব সময় বাঘ আসত।

আনিসুল হক:

ঢাকাতেও বাঘ আসত!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ঢাকায় বাঘ আমি প্রায় দেখেছি। ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডে একবার সামনাসামনি দেখেছি। আমি পুরানা পল্টনে থাকতাম। প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বেরোতাম। পল্টন থেকে পুরান ঢাকায় যাওয়ার রাস্তার দুপাশেই জঙ্গল। একটা ভয় ছিল। আর যখন পুরোনো এয়ারপোর্টের কাছে যেতাম, তখন ভয়টা ভীষণভাবে বেড়ে যেত। কারণ, ওখানে এর মাত্র ৫-৬ বছর আগে একটা বড় বাঘ মারা হয়েছিল—রিয়েল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুতরাং আমরা বাঘের সঙ্গে পরিচিত। আমাকে আধা বাঘই বলতে পারো।

আনিসুল হক:

বাঘের আত্মীয় যেহেতু। আপনি তো বাঘই বটে!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: জন্মের দিক থেকে বাঘ। কেমন? একবার দার্জিলিংয়ের দক্ষিণে যে ডুয়ার্স এলাকা, সেখানে গাড়িতে করে যাচ্ছি আমার খালুর সঙ্গে, সামনে হঠাৎ এক বিরাট বাঘ এসে দাঁড়িয়ে গেল। সুতরাং বাঘ আমার মিতা।

সাক্ষাৎকারের হাস্যোজ্জ্বল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
আনিসুল হক:

আপনার শৈশবে কি অনেক স্কুলে পড়তে হয়েছে? বাবার বদলির চাকরির কারণে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অনেক স্কুলে পড়েছি। প্রথমে তো একেবারে যখন ভর্তি হলাম ক্লাস ওয়ানে, টু পর্যন্ত একটা স্কুল। এটা করটিয়াতে। তারপরে গেলাম জামালপুরে, সেখানে গভর্নমেন্ট স্কুল। তারপরে গেলাম পাবনাতে, সেখানে রাধানগর মজুমদার একাডেমি। এই যে বারীণ মজুমদার, বাপ্পা মজুমদার...এদের পূর্বপুরুষ। বারীণ মজুমদারের বিয়েতে আমি ছিলাম। এটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে।  তারপরে ওখান থেকে পাবনা জিলা স্কুলে স্কুল শেষ করি।

আনিসুল হক:

কলেজ?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে পড়েছি। যেটাকে পিসি কলেজ বলে। তারপরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বা, তিনি ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন, নাকি বাংলা?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। এমএ করেছিলেন। পরে বাংলাতে এমএ করেছিলেন। আরও দুটোতে এমএ করতে চেয়েছিলেন। গণিত ও দর্শন। অঙ্কে খুব ভালো ছিলেন, কোনো দিন ১০০-এর নিচে নম্বর পাননি। আর দর্শনে করতে চেয়েছিলেন, তিনি আমাদের দর্শন পড়াতেন।

আনিসুল হক:

অসাধারণ ব্যাপার! বাংলায় এমএ, ইংরেজিতে এমএ, ১০০-এর নিচে পাননি গণিতে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আব্বা একটা অন্ধকার গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে সাত মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল ছিল না।

আনিসুল হক:

আপনার আব্বার নামটা...

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আযীমউদ্দিন আহমদ।

আনিসুল হক:

কিন্তু আপনার নামের সঙ্গে আহমদ নেই কেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: সেটা আব্বা জানেন। উনি দেননি। সাধারণত নানা, দাদারা নাম দেয়। সেকালে তাই দিত।

আনিসুল হক:

তাই দিত?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: নানা, দাদারা দিত। কারণ, বাপের কোনো অধিকার ছিল না। কেমন? সেই ‘হৈমন্তী’ গল্পের মধ্যে যে গল্প আমি কলেজে পড়াতাম, কিংবা পড়াতাম না…

আনিসুল হক:

সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: সেই ‘হৈমন্তী’ গল্পের মধ্যে একটা কথা আছে—ছেলে বলছে যে, ‘আমি ছিলাম বর, তাই বিবাহ ব্যাপারে মতামত দেওয়া আমার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন ছিল।’ সেটা দেবে তার বাবা, কারণ জমির মালিক হচ্ছে সেই বাবা, সম্পত্তির মালিক হচ্ছে সেই বাবা।

আনিসুল হক:

কাজেই আপনার জন্মের ওপরে যেমন আপনার হাত ছিল না, আপনার নামের ওপরেও আপনার হাত ছিল না।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাবারও ছিল না।

আনিসুল হক:

দাদাই নাম রাখলেন। এখন প্রসঙ্গ যেহেতু আসছে, আমি হাসছিলাম... আমি যা বলতে চাচ্ছিলাম, আপনি ঢাকা কলেজে যখন পড়াতেন, তখন আপনার ক্লাসে অন্য কলেজের ছাত্ররা এসেও বসে থাকত আপনার গল্প শোনার জন্য, আলোচনা শোনার জন্য। আপনার ছাত্ররা এখন তো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আপনার ছাত্ররা সবাই বলে, ‘হৈমন্তী’ গল্পটা আপনি নাকি ক্লাসে আরম্ভ করতেন, কিন্তু কখনো শেষ করেন নাই!

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: শেষ কে করে? শেষ সেই করে, যার কথা নেই।  যার কথা আছে, তার কথা কি কোনো দিন শেষ হয়?

আনিসুল হক:

আচ্ছা, আপনার বিয়েতে কি আপনার মত নেওয়া হয়েছিল?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি মত দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি বিয়ের আগে আমার স্ত্রীকে দেখিনি। তোমরা যে এখন দেখে, যাচিয়ে, খুঁটিয়ে বিয়ে করো, আমি সেটা করিনি। আমি দেখিনি পর্যন্ত। আমার মনে হয়েছে যে ভবিতব্যে যা আছে, সেটা আধ্যাত্মিক অর্থে না। মানে প্রেম করে বিয়ে করলেই যে বিয়ে সাকসেসফুল হবে, তা তো না।
আনিসুল হক: প্রেম করে বিয়ে করলেই বিয়ে সফল হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আবার প্রেম না করলেই যে বিয়ের পর সর্বনাশ হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। এটা একেবারেই একটা ভাগ্য-নিয়ন্ত্রিত ব্যাপার। ভাগ্য মানে অ্যাকসিডেন্ট। সুতরাং সেখানে এত দেখাদেখি করে কী হবে? বরং দেখাদেখি করে হতাশা বাড়তে পারে।

আনিসুল হক:

বিয়ের কত বছর হলো, স্যার?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ৬০ বছর।

আনিসুল হক:

৬০ বছর। আমাদের ভাবির নিশ্চয়ই অনেক গুণ। সহ্য করার ক্ষমতা অনেক।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অসীম ক্ষমতা। আমি আমার একটা বই তার নামে উৎসর্গ করেছি। তার মধ্যে লিখেছি যে ‘সহ্য করে যে সবচেয়ে সাহায্য করেছে।’

আনিসুল হক:

আর আপনার মতন সুদর্শন, বাগ্মী, টেলিভিশনের তারকা, সর্ব অর্থে আমাদের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা। তাঁর তো ভক্ত থাকবে, ভক্ত মানে ভক্তি থাকবে। এটা থাকাই উচিত।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: (হাসি)

আনিসুল হক:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আপনি বাংলা পড়ছেন, তখন থেকেই শিল্প-সাহিত্য করা শুরু করে দিয়েছেন। কিছুটা প্রতিবাদী ধরনের।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তারও বহু আগে থেকে, মানে শিল্প-সাহিত্য করিনি কিন্তু সাহিত্য পড়তে শুরু করে দিয়েছি ভীষণভাবে, সেটা হলো কলেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। তার আগে পর্যন্ত সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই ছিল না। তার আগে স্কুলে ‘টম কাকার কুটির’, ‘রবিনহুড’, ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’—এ রকম এই গোটা পঁচিশেক বই আমি হয়তো পড়েছিলাম।  এরপরে আমার আর ইন্টারেস্ট হয়নি।

আমি যখন স্কুলে, মানে আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত লাইব্রেরির মেম্বার ছিলাম—এই সব বইটই পড়েছি। তারপরে চলে গেলাম পাবনা জিলা স্কুলে। সেখানে কী করে যেন আমরা কিছু লাইব্রেরির পড়ুয়া ছেলে একসঙ্গে হয়ে একটা সোসাইটি বানিয়ে ফেললাম এবং সে সোসাইটির নাম ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি। নাম শুনলে মূর্ছা যাবে হয়তো। ফিলোসফি মানে জানি না, ফিলোসফি বিষয়টা কী জানি না। আমাদের হিরো হলেন বার্নার্ড শ, জর্জ বার্নার্ড শ। দুর্ধর্ষ নাট্যকার, সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে ফেলেছেন। ভাবলাম, ইনি শ্রেষ্ঠ ফিলসফার হবেন। কিন্তু বার্নার্ড শ তো আসলে লেখক। তাঁর সাত-আটটা নাটক আমরা পড়ে ফেললাম। দুই সপ্তাহে একটা করে নাটক পড়তাম। তারপরে সেটার ওপরে ডিসকাশন হতো। নাটক একটু সোজা হয়, ওটা তো ডায়ালগ, মুখের কথা। বুঝতে সুবিধা আছে। আর বার্নার্ড শর ভাষা! কী ধারালো, কী যে উজ্জ্বল! কী যে প্রাণকে আঘাত করা ভাষা। ইতিমধ্যে পরীক্ষার দামামা বাজছে, স্কুল শেষ হয়ে গেল, ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি শেষ হয়ে গেল।

এরপর কলেজে গেলাম। প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে। সেই কলেজের শিক্ষকদের মতো শিক্ষক আমি আর দেখিওনি, পাইওনি জীবনে। প্রফুল্ল চন্দ্র নিজে এই কলেজটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজে। উনি কলকাতা থেকে খুঁজে খুঁজে খুঁজে খুঁজে সেরা মাস্টারদের কলেজে নিয়ে এলেন। আমার আব্বা ছিলেন একদম প্রথম ব্যাচের ছাত্র।
সেই শিক্ষকেরা আমি ওখানে ভর্তি হওয়ার এক বছর পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। তারপরে মুসলিম লীগের অত্যাচারে এবং স্থূলতায় সেই স্নিগ্ধ মানুষগুলো, সুমার্জিত মানুষগুলো একদিন হঠাৎ কলকাতায়  চলে গেলেন।

কিন্তু তাদের যে পড়ানো, তাদের যে নলেজ, যে কমিউনিকেশন.. আমার সময়ে কলেজ বিল্ডিংগুলো একটু অন্ধকার অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ছিল। কিন্তু কলেজের মধ্যে ঢুকলে মনে হতো আলো—পাখা ঝাপটানো আলো। এত উজ্জ্বলতা, এত প্রাণ! কলেজে আমি সকাল থেকে ক্লাস করতে শুরু করতাম। যে ক্লাস পেতাম, ঢুকে যেতাম। আমি জানি যে প্রত্যেকটা ক্লাসে একজন করে শিক্ষক আছেন, যিনি প্রাণকে জাগিয়ে দিতে পারেন।

আনিসুল হক:

আপনি যে পরবর্তীকালে শিক্ষক হলেন, এর পেছনে আপনার কলেজের শিক্ষকদের নিশ্চয়ই একটা অবদান আছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, সেটা তো আছেই। তবে সবচেয়ে বেশি আছে আমার আব্বার। আব্বা খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মতোই শিক্ষক ছিলেন। ছাত্ররা যখন আব্বা সম্পর্কে কথা বলত, তখন মনে হতো, কোনো দেবতা-টেবতা নিয়ে হয়তো কথা বলছে। তখন মনে হতো, যদি হতেই হয়, তাহলে দেবতা হওয়াই ভালো। আদর্শবাদী না শুধু, তাদের নলেজ, তাদের ডেডিকেশন, তাদের স্বপ্ন, তাদের প্রতি মুহূর্তের ভাবনা, পড়াশোনা…

আনিসুল হক:

এ জন্য সমাজে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাও ছিল।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: নিশ্চয়ই। আমাদের একজন শিক্ষক একদিন আমাকে বললেন যে আজকাল আর শিক্ষকদের সেই সম্মান নেই। আমি বললাম যে এটা হতে পারে না, সম্মানযোগ্য লোকের সম্মান নেই। এটা একটা অসম্ভব সমাজেও সম্ভব না। যদি সম্মান না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে ওই অসম্মানের যোগ্যতা তার নিজের মধ্যেই সম্ভবত আছে।

আনিসুল হক:

খুবই দুঃখের ব্যাপার। আচ্ছা, আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ঢাকায় যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করার উদ্যোগ হলো, সেটার সঙ্গে তো আপনি যুক্ত ছিলেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: একদম প্রথম থেকে।

আনিসুল হক:

সেই সময়ের স্মৃতিটা যদি বলতেন

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তখন আমরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। একেবারেই মানে কচিকাঁচার মেলা। তখন আইয়ুব খানের সেই ভয়ংকর সামরিক শাসন। সারা জাতি শৃঙ্খলিত, একটা কথা বলা যাবে না। রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যাবে না। সমস্ত দেশ ত্রস্ত এবং নিস্পন্দ। এই সময়ে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী। আমরা ভাবলাম, বাঙালিত্বকে অনুভব করার এই একটা সুযোগ। স্থূল, মধ্যযুগীয়,  সামন্তবাদী একটা রাষ্ট্রে  ডেমোক্রেসিকে/গণতন্ত্রকে  অনুভব করার একটা মাত্র উপায়, এটা হচ্ছে যদি রবীন্দ্রশতবার্ষিকীটা আমরা করতে পারি। তার মাধ্যমে আবার আমরা আধুনিকতাকে, বাঙালিত্বকে, দেশপ্রেমকে অনুভব করতে পারি—বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক পুণ্য হোক পুণ্য হোক—আবার হয়তো আমরা ফিরে পেতে পারি। তখন আমি আর আমার এক বন্ধু, সে খুব ভালো ছাত্র ছিল, আমরা ঠিক করলাম, আমরা এক বছর নষ্ট করব, কিন্তু এইটা করব। তখন আমরা নানান কৌশলে... কেউ আসতে রাজি না। এর মধ্যে কেউ ইনভলভ হতে রাজি না। আমরা কাকে প্রেসিডেন্ট করব, কাকে জেনারেল সেক্রেটারি করব? সব বড় বড় মানুষ, তাদের নিয়ে আসতে হবে। সত্যি কথা বললে কেউ আসতে চাইবে না। আতঙ্ক, ভয়, কী হয় না হয়। বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদকে ভাবলাম। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবেন? পারতেও পারেন, কারণ উনি সম্ভবত এ কে ফজলুল হক সাহেবের, মানে শেরেবাংলার ভাগনে, এ রকম কিছু একটা ছিলেন। কিন্তু কেউ তো রাজি না। তখন অমুককে গিয়ে বললাম, অমুক রাজি হয়েছে। আপনি যদি রাজি হতেন! অমুককে গিয়ে বললাম, অমুক রাজি হয়েছেন, আপনি যদি রাজি হতেন। প্রথমে ডক্টর খান সারওয়ার মুর্শিদকে মিথ্যা কথা বলে রাজি করালাম এবং সেটা দিয়ে ডক্টর জি সি দেব, গোবিন্দচন্দ্র দেব, যিনি শহীদ হয়েছিলেন, তাঁকে রাজি করালাম। তাঁদের দিয়ে আবার জাস্টিস মুর্শেদের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধরলাম। তখন আমাদের বয়স ২০-২১। তখন আর বুড়ো বয়সে চুল পাকিয়ে এমএ পাস করতে হতো না। মানে এখন তো প্রায় নাতি-নাতনি-সহ ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়। তো সেটা তো তখন ছিল না। তো এভাবে আমরা এটা করলাম। করে একসময় যখন সবকিছু প্রস্তুত হলো, তখন সেই সবকিছু আমরা বড়দের হাতে দিলাম।

আনিসুল হক:

১৯৭৮ সালে প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ওই ধারণাটা শুরু হলো, বইপড়া, পাঠচক্র।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, এটা ১৯৬৮ সালে শুরু হয়েছে।

আনিসুল হক:

’৬৮ সালে। তখন ঢাকা কলেজে পড়তেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তখন ঢাকা কলেজ দেশের একদম সেরা ছেলেরা পড়ত। তারা আজও বাংলাদেশ শাসন করছে।

আনিসুল হক:

ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাস কি তখন এখন যেখানে আছে, সেখানেই ছিল?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ। আমি যখন ছিলাম, তখন এখানেই ছিল। তার কিছুদিন আগেই অন্য জায়গায় ছিল—পুরান ঢাকায়।

’৬৮ সালে আমরা একটা পাঠচক্র করলাম এবং তার মধ্যে অতি প্রখর কয়েকটা ছেলে ছিল। এখনো আমার মনে পড়ে, কেউ হয়তো সমস্ত বোর্ডের ফার্স্ট, কেউ হয়তো অমুক, কেউ হয়তো তমুক। মানে একটা ঝলমলে ব্যাপার! কিন্তু ওটা চলল না। কিছুদিনের মধ্যেই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এল এবং দেশের অনেক মানে খারাপ জিনিসের সঙ্গে  দু-চারটা ভালো জিনিসও উড়ে চলে গেল এবং যে ভালো জিনিসগুলো উড়ে চলে গেল, তার মধ্যে আমাদের পাঠচক্র একটা। আমার মনে আছে, প্রথম দিনই আমরা নৈরাজ্যবাদের ওপর বই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।  ১০ জন মেম্বার ছিল। নৈরাজ্যবাদের ওপরে একজন পড়ত আর সবাই পড়ে আসত। তারপরে ইন্টারঅ্যাকশন হতো।  

তারপর আমরা ভাবলাম যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সোনার বাংলা আমরা পেয়ে গেছি। এখন আমাদের কিছু করণীয় নেই। এখন একটা কাঁথা ভালোমতো মুড়ি দিয়ে ভালো ঘুম দিলেই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হয়ে যাবে। তো পরে বুঝলাম যে না, সোনার বাংলা মানে একটা দেশের রাস্তাগুলো সোনার, পুকুরগুলো সোনার, দালানগুলো সোনার, সেটাকে সোনার বাংলা বলে না। সোনার বাংলা মানে সোনার মানুষ। কেমন? আলোকিত মানুষ। ১০ বছর অপেক্ষা করার পরে আবার আমরা আরম্ভ করলাম।

এবারও ১০ জন নিয়ে, ১০টা ছেলে। এবার ৩৫টা টাকা একজন দিলেন, আমরা একটা বইয়ের ১০টা কপি কিনলাম। সেই বইটার নামও মনে আছে, সেই বইটার নাম হচ্ছে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। জসীমউদ্‌দীনের লেখা। ছোট বই, দাম কম। সেই অর্থে সব মিলিয়ে আমরা কিনলাম। পড়লাম। পরের সপ্তাহে আবার বসলাম বইটার ওপরে নানানভাবে… বইটাকে একেবারে তন্ন তন্ন করে দেখা—কেন তিনি লিখেছেন? কোন স্বপ্ন থেকে লিখেছেন? কী বলতে চান লেখক, কবি কী বলতে চান মানবজাতির কাছে এই বইয়ের মাধ্যমে?

আনিসুল হক:

আলোচনা শুরু হলো। এটা করতে গিয়ে সুবিধা নিশ্চয়ই হয়েছে। কারণ আপনি তার আগেই টেলিভিশনে যুক্ত হয়েছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: টেলিভিশন, ব্যাপারটা হচ্ছে যে টেলিভিশনের ওপরে আমি খুব ক্ষিপ্ত। কারণ, টেলিভিশন আমার জীবন থেকে ১০টা শ্রেষ্ঠ বছর...

আনিসুল হক:

কিন্তু আপনার ওই পরিচিতি তো এখনো কাজে লাগে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: কিন্তু টেলিভিশনটা যদি না করা থাকত, তাহলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র হতো না। কারণ, একজন বুদ্ধিজীবী টাকা চাচ্ছে, যে আমাকে ১০ লাখ টাকা দেবে, এটা কে দেবে?

প্রথম আলো:

স্যার, ওই সময়টা তো আমি প্রত্যক্ষ করি নাই। কারণ আমি তো রংপুরে। ’৭৮ সালে আমি ক্লাস এইটে পড়ি। ’৭২ সালে আমি ক্লাস টুতে পড়ি। রংপুরে তখন টেলিভিশন ছিলই না। ওখানে থাকার কোনো কারণ নেই, কারণ ওখানে টেলিভিশন দেখা যেত না। ’৭৮ সালের পরে টেলিভিশন উপকেন্দ্র রংপুরে হলো। তারপরে আমরা সাদাকালো টেলিভিশন দেখতে পেলাম। আমি কল্পনা করতে পারি, টেলিভিশন ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত ঘরে ছিল। তারা সবাই শিক্ষিত এবং তখনকার মধ্যবিত্ত তো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। লুটেরাদের টাকা হয়েছে, এটা তো অনেক পরের ঘটনা।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ। আমরা তখন যাদের জন্য প্রোগ্রাম করেছি, তুমি বোঝো, আমার প্রোগ্রাম পপুলার হয়েছে।

আনিসুল হক:

সেটাই আমি বলছি। আপনি এক ঘণ্টার আলোচনা অনুষ্ঠান করছেন, আপনার কথা শোনার জন্য সবাই টেলিভিশনের সামনে সন্ধ্যার সময় বসে আছে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: শুধু আমার না, মুনীর চৌধুরী স্যারের মতো মানুষের কথা শোনার জন্য লোকে বসে আছে। মুনীর স্যার তো আমার চেয়ে ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন।
ইন্টেলেকচুয়ালাইজড কথা, তাঁর কথা একেবারে এক ঘণ্টা ধরে শুনছে মানুষ। মানে তখন শ্রোতার যে মান, সেই মান আজকের শ্রোতার চেয়ে অনেক ওপরে। তো সে জন্য আমরা সেটা করতে পেরেছিলাম। শ্রোতায় ও বক্তার একটা সংযোগ ছিল।

আনিসুল হক:

কাজেই আপনার অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ভক্ত হয়েছিল এবং তারা ভালোবাসত। কারণ, তখন দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত—এই দেশকে বড় করতে হবে, বড় বাংলাদেশ চাই এবং সেখানে একটু কিছু ভালো পেলেই মানুষ একদম উল্লসিত হয়ে উঠত।

আনিসুল হক:

আপনার যে সিনেমার নায়ক হওয়ার কথা ছিল, সেটার কী হলো?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: সিনেমার নায়ক! (হাসি) প্রথমে একবার একজনের সঙ্গে একটা সিনেমাতে নামব ঠিক হলো। এইটা শুনে আমার বড় বোন, যিনি মেডিকেলে পড়তেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ গুছিয়ে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হলেন। আব্বা থাকতেন তখন মুন্সিগঞ্জে। বোন বললেন, তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি, না হলে আমরা বাড়িতে থাকব।

আনিসুল হক:

বাড়িতে কোনো সিনেমার লোক থাকতে পারবে না।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না।

তারপরে ১৯৬৮ সালের দিকে এক ভদ্রলোক একেবারে পাগলের মতো ধরে বসলেন, ‘কত টাকা চাই?’ যেন টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। ‘কত টাকা চাই?’ আমার সঙ্গে কথা হয় নাই। কিন্তু আমার এক চ্যালার সঙ্গে তাঁদের কথা হয়। তাঁরা বললেন, ২৮ হাজার টাকা দেবেন।

আনিসুল হক:

ওই সময় ২৮ হাজার টাকা তো অনেক টাকা।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি বললাম, ‘আমি তো মাস্টার, ছাত্রদের পড়াই। আমি কি করে  নায়িকার হাত ধরে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় বা সমুদ্রের ধারে ধারে নাচব, গান করব?’ শেষ পর্যন্ত হলো না, করলাম না। যিনি এটা করতে চেয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘এটি নিষ্পাপ চরিত্র, বিলাতফেরত ডাক্তার। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। সম্মানের সঙ্গে অভিনয় করতে পারবেন।’

শেষমেশ ছবিটা শেষ হলো, আমার জায়গায় দেশখ্যাত একজন নায়ক অভিনয় করলেন। একদিন বলাকা সিনেমা হলে ছবিটি মুক্তি পেল। আমি নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বলাকার দিকে তাকিয়ে দেখি, বিলবোর্ডের মত.. সেই নিষ্পাপ ডাক্তার নায়িকাকে আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম, ‘হায়রে, এই সিনেমা যদি আমি করতাম!’ আমার ছাত্ররা এখান দিয়েই কলেজে যায়। সবাই এখানে দাঁড়িয়ে বলত, ‘স্যার, ভালোই তো আছেন!’ আমার সিনেমা করা শেষ হয়ে গেল।
আনিসুল হক: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এখন যে জায়গাটা, ওই জায়গায় তো আমি ’৮৫ সালে, ’৮৬ সালে আসা শুরু করলাম। কারণ, তখন আমি ঢাকায় এসে গেছি। খুব সুন্দর লাল ইটের ভবন, গাছ। ওই জমি আপনারা কবে পেয়েছিলেন, স্যার?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ওই জমি পেতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। ঢাকার প্রথম মেয়র ছিল হাসনাত, আবুল হাসনাত। আমার সহপাঠী। আমার সহপাঠীরা, ছাত্রীরা, বন্ধুরাই এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বানিয়ে দিয়েছে। সে ছিল আমাদের সহপাঠী, কিন্তু আমাদের শত্রু দলের।

আনিসুল হক:

এনএসএফ করত নাকি?

নিজের জীবনের নানা ঘটনার কথা বলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এনএসএফ করত। তখন তো আমাদের মধ্যে বিরাট বৈরিতা, দ্বন্দ্ব।

ইউনিভার্সিটির জীবন। আমি এসএম হলে থাকতাম। সেখানে থেকে এমন ধাওয়া দিল যে আমাকে শহীদুল্লাহ হলে এসে আশ্রয় নিতে হলো। আমি আর এনায়েতুল্লাহ, আবু জাফর এনায়েতুল্লাহ খান, পরে বিখ্যাত সাংবাদিক, মন্ত্রীও হয়েছেন।   আমরা এক খাটে রাতের পর রাত শুয়ে ঘুমিয়েছি।  

কিন্তু যখন আমি গেলাম, আমি শুনলাম যে সিটি করপোরেশনের কাছে ১৪টা বাড়ি আছে। সিটি করপোরেশনের না, এটা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের বাড়ি কিন্তু সিটি করপোরেশন ওটার ব্যবহারকারী এবং সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষার উন্নতির জন্য ওই বাড়িগুলো ব্যবহার করা হবে। একজন আমাকে বুদ্ধি দিল যে হাসনাত তোমাদের সঙ্গে পড়ত। তুমি হাসনাতকে বলো। আমি তখন শত্রু দল।  শত্রু তো আমরা। কী করে যাই? লজ্জাও লাগে। কিন্তু কী করব? সে তখন মেয়র। সে রাজা। তার কাছে না গিয়ে উপায় নেই। তারপরে গেলাম। আমাকে দেখে বলে, ‘এখন কী জন্য?’ কিন্তু হাসনাত ছিল একটা বলিষ্ঠ মানুষ।

আনিসুল হক:

হ্যাঁ, লম্বা-চওড়া, স্বাস্থ্য ভালো।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: শুধু স্বাস্থ্য ভালো না, তার হৃদয়টাও বলিষ্ঠ ছিল। হ্যাঁ, সে বন্ধুত্বকে খুব গুরুত্ব দিত। মানে দল, মত, শত্রু সব ঠিক আছে, কিন্তু যদি একবার বন্ধু হয়, ক্লোজ হয়, তার জন্য সে একদম জীবন দিয়ে দেবে। সে বলল যে ‘কী  করবার চান?’ সে তো আবার পুরান ঢাকার মানুষ। ‘কী করবার চান?’ আমি বললাম, লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতিচর্চা।  সে বলল, ‘দিব, একটা বাড়ি আপনারে দিব।’ সে নিজে আমাকে ড্রাইভ করে অনেকগুলো বাড়ি দেখাল, ১৪টা বাড়ি।  প্রথমেই এই বাড়িটা দেখলাম এবং আমার পছন্দ হয়ে গেল। আমি বললাম যে এই বাড়িটা আমার দরকার।
তারপর হাসনাতদের ক্ষমতা চলে গেলেও বাড়িটা আমাদের হয়েছে।

আনিসুল হক:

ওই বাড়িকে সংস্কার করে সুন্দর রূপ দেওয়া হয়েছিল

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, আমরা নিজেরাই করেছিলাম। উত্তম সাহা নামের তরুণ একজন আর্কিটেক্ট ছিল। গাছপালা লাগিয়েছিলাম আমি, সব মিলিয়ে কুঞ্জের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।

আনিসুল হক:

এখন যে বড় বিল্ডিং উঠেছে, সেটাও সুন্দর, তবে আগের বাড়িটা আপনি মিস করেন না?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমার চাইতে বেশি মিস কি কেউ করে?  যখন ওই বাড়িটা ভাঙলাম, অনেকেই প্রতিবাদ করল, আন্দোলন হলো, বলল এটা ভাঙা যাবে না, এটা ঐতিহ্য। আমাদের কষ্ট হচ্ছিল। আমি বললাম, সবার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কার কষ্ট সবচেয়ে বেশি হচ্ছে? এর প্রতিটি ইটের সঙ্গে আমি যুক্ত।

আনিসুল হক:

আমার মনে হয়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আন্দোলন, যেটার মধ্য দিয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বাছাই করা বই পেল এবং বইয়ের স্বাদ পেল।  তাদের অনেকেই চিরদিনের জন্য ভালো পাঠক হবে, ভালো মানুষ হবে। এটার একটা সুফল আমরা পাচ্ছি। আমি বাংলাদেশের যেখানেই যাই, পৃথিবীর যেখানেই যাই, আমরা যাঁদের কাছে যাই, তাঁদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিওয়ালা লোক যেমন আছেন, তেমনি হয়তো কেউ মাইক্রোসফটের সফল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ হয়তো ভালো একটা আমেরিকান হাসপাতালের বড় ডাক্তার। তাঁরা এসে কিন্তু বলেন যে আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মধ্য থেকে এসেছি। এটা একটা খুব সুফল। আপনি দেখেন কি না জানি না, আমি দেখি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, আমিও দেখি। এবং একটা কথা আমার মনে হয় যে আমরা এই যে আমরা কিন্তু অনেক ছেলেমেয়েকে নার্চার করেছি, লালন করেছি। তো সোয়া দুই কোটির ওপরে, হ্যাঁ? তো এর মধ্য থেকে ফেলে ছড়িয়ে এটা করে, সেটা করে তারপরও তো ১০-২০ লাখ ছেলেমেয়ে আমরা এক্সপেক্ট করতে পারি। যারা দেশের জন্য কিছু না কিছু, কোনো না কোনো জায়গায় করছে।

আনিসুল হক:

নিশ্চয়ই। ৯০ ভাগ বাদ দিয়ে ১০ ভাগ হলেও ২০ লাখ, তার মধ্যে ১ শতাংশ হলেও ২ লাখ এবং ২ লাখের মধ্যে ১০ জন যোগ্য নেতা থাকে… তাহলে পৃথিবী বদলে যেতে পারে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ।

আনিসুল হক:

এবং আমার মনে হয় যে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হলো, এই চিন্তা যারা করতে পেরেছিল, তারাও বই পড়া, সিনেমা দেখা মানুষ। তারা সরাসরি এসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ক্লাস হয়তো করেনি, কিন্তু আলো তো স্যার ছড়ায়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, ওটার সঙ্গে, মানে মনের দিক থেকে মানবিক বা মানসিক পরিমণ্ডলে এটা কাজ করে। কারণ, এখন তরুণ সমাজ কমবেশি আমাদের এই ভাবধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত।

আনিসুল হক:

বই মানুষকে যে কীভাবে আলোকিত করবে আমরা জানি না। কাকে, কোন বই কীভাবে উদ্বুদ্ধ করবে… আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে দেশ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে স্বাধীনভাবে ভাবা শুরু করেছে, এটাও তো একটা ইতিবাচক দিক।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: কারণ, কোনো দিন আমাদের রাষ্ট্র ছিল না। এই প্রথম রাষ্ট্রভাবনা। আমাদের সামনে কিছুই নেই, এই প্রথমবারের মতো এটা করছি। সেটা তো খুব কঠিন হওয়ার কথা। যেসব দেশে দুই হাজার বছর, দেড় হাজার বছর, এক হাজার বছর ধরে রাষ্ট্র আছে, তাদের অবস্থা আর আমাদের অবস্থা এক নাকি? আমাদেরটা অনেক কঠিন। অনেকে খুব হতাশ হয়ে যায় যে এর মধ্যে কী করে হবে? কী করে হবে? আমি বলি যে না, এই প্রথম আমরা উঠে আসছি। আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। সুতরাং এই ধৈর্য এবং এই সংগ্রাম আমাদের করতে হবে। গায়ের থেকে রক্তটা দিতে হবে। তা না হলে ওটা হবে না।

আনিসুল হক:

তো আমি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে এসেছি যেমন, তেমন তো কবি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছেও এসেছি। স্যারের বই তো আমি প্রায় সব কটিই পড়েছি এবং অনেকগুলোর ফ্ল্যাপ/ ব্লার্ব এগুলো আমি লিখে দিই। অসাধারণ ছোটগল্প লেখেন, সুন্দর নাটক লিখেছেন এবং কবিতা লেখেন। ‘রোদনরূপসী’ নামে আপনার বইও আছে। আপনার জীবনে স্যার এই যে লেখালেখি, আমি মনে করি যে অনুপ্রেরণা হিসেবে নারী একটা খুবই বড় বিষয়। আমি একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম যে নারীচিত্ত জয়ের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কারণে আমি কবিতা লিখিনি। আপনার ক্ষেত্রে কী হয়, স্যার? আপনি যখন একটা ক্রিয়েটিভ কাজ করেন, সাহিত্যিক-শৈল্পিক কাজ করেন, পেছনে কি নারীর অনুপ্রেরণা বোধ করেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: নারীর.. কোনো বিশেষ নারীর অনুপ্রেরণাও হয়তো থাকে। অনেক সময় অনেক কাজের মধ্যেই থাকে।

এটা আমি দুর্বৃত্ত বলে না, আমি পুরুষ জন্ম পেয়েছি বলে। বিশেষ মানুষ না থাকলেও নারীত্ব আমাকে ঘিরে আছে। আমি যে কয় দিন এই পৃথিবীতে থাকব, নারী আমাকে ঘিরে থাকবে বা কোনো নারী যত দিন পৃথিবীতে আছে, পুরুষানুভূতি তাকে ঘিরে রাখবে। এর বাইরে আমরা কেউ না। আমাদের বেঁচে থাকা, ফার্স্ট উই হ্যাভ টু ফিড আওয়ারসেলভস। আমাদের বেঁচে থাকা। তারপরে আমাদের দ্বিতীয়টা হচ্ছে এই লিবিডো। তাই না? তো এর হাত থেকে তো কারও মুক্তি নেই। এবং এই জন্যই তো মানুষ বেঁচে থাকে। আমার মনে হয়, এই দুটোকে যদি তুলে নেওয়া হতো, পৃথিবীতে কি কেউ বাঁচতে চাইত? কেমন? নারী নেই পৃথিবীতে...

আনিসুল হক:

আর যা-ই থাকুক কবিতা থাকত না, গান থাকত না।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: কবিতা না, পুরুষই থাকত না। পুরুষেরা থাকবে, থেকে লাভ কী?

আনিসুল হক:

একা একা লাগে…

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এই যে আমাদের বিবাহিত জীবনগুলো অধিকাংশ এত দুঃখময়, এত নির্যাতনপূর্ণ, এত নিগ্রহে ভরা, প্রায় প্রতিটা বাড়িতে অশান্তি। তারপরও তো বলে যে ‘দিল্লি কা লাড্ডু জো খায়া, ওভি পস্তায়া।’

আনিসুল হক:

আমি বলি স্যার, সুখী দম্পতি, এটা মিথ। এটা কল্পনা।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এটা কল্পনা। এটা মানুষ ভাবে। ওই স্বপ্নটাই তার বাস্তব।

আনিসুল হক:

ওই স্বপ্নের কাছে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা থেকে…

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ওই আকাঙ্ক্ষাটাই হচ্ছে তাকে পাওয়া

আনিসুল হক:

আমার প্রিয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটা খুব সুন্দর কথা আছে, বিবাহিত জীবনে সুখ ব্যাপার না, আসল কথা হচ্ছে স্থায়িত্ব। থেকে যেতে হয়। একটা মায়া তৈরি হলে, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলে এটা সম্ভব।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হওয়াও খুব কঠিন, কারণ শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হতে গেলে তো ফ্রিকোয়েন্সিতে মিল থাকতে হবে।

আনিসুল হক:

আরেকটা ব্যাপার, একটু দূরের প্রতি স্যার আগ্রহ বেশি থাকে তো, বেশি কাছে থাকলে দৈনন্দিন হয়ে যায় আরকি।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, ফ্রিকোয়েন্সি থাকতে হবে। কথা বলতে পারতে হবে, তারপর একটা ওয়েভলেংথে মিল থাকতে হবে। কিছু বোঝাবুঝি থাকতে হবে। এগুলো হচ্ছে আনন্দের উৎস। এগুলো না থাকলেও কোনোরকমে ঝগড়াঝাঁটি করে চলবে। কিন্তু এগুলো থাকলে জীবন সুন্দর হয়। এবং সেই জীবন কয়টা আছে পৃথিবীতে? যে যতই দেখাক, যতই বলুক, কেমন? বুকের কাছে কান নিয়ে যদি আমরা শুনি যে তোমার বুকের মধ্যে কী… আনন্দ না বেদনা, যখন সেটা করবে, আমরা বুঝতে পারব।

আনিসুল হক:

৮৬ বছর তো হয়েই গেল। ১০৬ বছর পর্যন্ত...

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এগুলো দিয়ে কী করব? এই জীবনটা তো একটা গিফট। এই জীবনে তো আমি না-ও আসতে পারতাম।

আনিসুল হক:

নিশ্চয়ই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: আমি তো একটা ব্যাঙ হয়ে জন্মাতে পারতাম এবং তখন গ্যা গো গ্যা গো করতে করতে আমার জীবন যেত। সেখানে আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি। এত অনুভূতি নিয়ে জন্মেছি। এত বুদ্ধি নিয়ে জন্মেছি। আমি না শুধু, সমস্ত মানবজাতি।
এত বিস্ময়কর, এত আনন্দময়, এত স্বপ্নে ভরা পৃথিবী। এখানে আমি জন্মেছি।

তারপরও অনেকে বলে যাবে পৃথিবীতে কিছু পাইনি। মানে আমি এই ধরনের মানুষকে ধিক্কার দিই।

এইখানেও কিছু পেলি না, এখানেও কিছু পাবি না। ওইখানে পেতে গেলে তো এখানে পেতে হবে।

আনিসুল হক:

আমরা স্যার শেষ করব…সবাইকে ধন্যবাদ। আপনাকে ধন্যবাদ। বিদায়ের আগে আপনি যদি দর্শকদের উদ্দেশে যেকোনো কবিতা থেকে ২-৪ লাইন বলেন...

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাংলা আর বিহারের মাঝামাঝি মিথিলা নামে একটা জায়গা ছিল। ওখানকার ভাষা এই বাংলা-হিন্দি মেশানো মৈথিলী ভাষা বলা হতো। তো সেখানে বিদ্যাপতি বিখ্যাত, ওই ভাষায় তিনি লিখেছেন। তো কবিতাটার কথা হচ্ছে যে রাধা কতটা সুন্দরী। এই বর্ণনাটা তিনি দিচ্ছেন। তো কবিতাটা আরম্ভ হচ্ছে এভাবে যে রাধা আর রাধার সখী, তাঁরা দুজন বসে আছেন। হঠাৎ সখী বলছেন, ‘রাধা অঞ্চলে বদন ছপাবহ গোরি।’ অঞ্চলে মানে আঁচলে, বদন মানে তোমার মুখ, ছপাবহ মানে ছিপাও, তাড়াতাড়ি ঢেকে ফেলো আঁচল দিয়ে তোমার মুখ।

বলে, ‘কেন বাবা, আমি এখানে বসে আছি। আমি তো কারও পাকা ধানের মই দিইনি। আমার কেন মুখ ঢাকতে হবে?’ বলে, ‘কারণ আছে। কী কারণ? রাজা শুনইছি চাঁদক চোরি।’ রাজার কাছে খবর গেছে যে আকাশ থেকে চাঁদ নাকি চুরি গেছে এবং রাজার চরেরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে যে কে সেই আকাশ থেকে চাঁদকে চুরি করে এনে রেখেছে। তো সেই রাজার চরেরা এসে গেছে প্রায়, তাদের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে এবং গলার আওয়াজ। তারা কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো চলে আসবে এবং এসে তোমাকে দেখলেই তো বুঝতে পারবে যে...তো সুতরাং তাড়াতাড়ি মুখ আঁচলে ঢাকো। তারপরেই বলছে যে ‘না রাধা, আমি ঠিক বলিনি। রাজার চরেরা আসুক এবং তারা যদি রসিক হয় এবং রূপকে দেখার চোখ যদি তাদের থাকে, তাহলে তোমার দিকে তাকালেই তারা বুঝবে যে তুমি চাঁদকে চুরি করোনি। কারণ, চাঁদের মুখেও কলঙ্ক আছে, কিন্তু তোমার মুখে কলঙ্ক নেই।’