শিলা তোমাকে দেখার জন্য

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাবা ঢাকা কলেজ থেকে তিতুমীর কলেজে বদলি হলেন। সেটা ১৯৭৭ সাল। যথারীতি বিদ্যালয় পরিবর্তন। ভর্তি হলাম শহীদ বীর উত্তম আনোয়ার উচ্চবিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। আমার সেকশনের নাম ছিল জিনিয়া। প্রথম দিন ক্লাস, টিফিন, সুবিশাল মাঠে ঘণ্টাখানেক পিটি, ক্লাসরুম পরিষ্কার করতে করতে আমি যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য আকুল, চোখে পড়ল তাকে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পরদিন অনেক গল্প হলো প্রচণ্ড চঞ্চল, উদ্দাম, ছটফটে প্রজাপতি আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল শিলার সঙ্গে।

শিলা আর আমার বাসাও ছিল পাশাপাশি। ওরা আণবিক শক্তি কমিশনের সরকারি বাসায় থাকত। ওর বাবা পরমাণুবিজ্ঞানী ড. নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আন্টি আর ছোট্ট ভাই এনামসহ। ছুটির দিন দৌড়ে চলে যেতাম শিলার বাসায়। অনেক গল্প, হাসাহাসি। কারক নির্ণয়ের বাক্যগুলোকে উল্টেপাল্টে বানিয়ে মজা করা।

শিলাও আসত আমাদের সুবিশাল প্রিন্সিপাল বাংলোতে। আমার বাবা মো. আলেম আলী তখন ভাইস প্রিন্সিপাল। তখনকার প্রিন্সিপাল স্যার বাংলোয় না থাকায় আমরা সেখানে থাকতাম। তবে শিলা এলে তখন খেলা হতো না। ছুটে চলে যেতাম তিতুমীর কলেজের লাইব্রেরিতে। দুই বন্ধু মিলে গোগ্রাসে গিলতাম নীহাররঞ্জন রায়ের কিরীটী, নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা, দ্বীপ দ্বীপান্তরসহ অসংখ্য বই। লাইব্রেরিতে কোনো বই এক কপি থাকলে দুজনে জোড়া মাথা হয়ে পড়তাম। স্কুলে বা বাসায় খেলাধুলার চেয়ে বই পড়া ও বই এর গল্প, রহস্য অনুসন্ধান করেই সময় কাটত বেশি। জুল ভার্ন আর বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য, আফ্রিকার গভীর বনে শিলা আর শিমুল (আমার ডাকনাম) হারিয়ে যেত বহুদিন।

যখন সিক্সে পড়ি, একদিন দেখি শিলা খুব গম্ভীর। মন খারাপ। হঠাৎ বলল, ওর বাবা ইরান চলে যাবেন ওদের নিয়ে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। কিশোরী মনে অনেক ব্যথা লাগল। শিলা বলল চিঠি লিখব।

ইরান গিয়ে পরপর দুটো চিঠি লিখেছিল শিলা, যা এখনো আমার কাছে আছে। চমৎকার ফুলপাতা ডিজাইনের প্যাড, মাঝখানে মুক্তাঝরা হাতে আবেগীয় লেখা। ইরানের সংস্কৃতির বর্ণনাও থাকত।

তখনকার সময় জিপিও ছাড়া চিঠি বাইরে পাঠানো যেত না। আমি দুটো চিঠিরই উত্তর সঙ্গে সঙ্গে আমার এক ঘনিষ্ঠজনকে পোস্ট করতে দিয়েছিলাম। এরপর প্রতিদিনই তিতুমীর কলেজে ডাকবাবু চাচা এলে আমি দৌড়ে যেতাম শিলার চিঠির জন্য। একসময় এ অপেক্ষা অভিমানে রূপ নিল। ভাবলাম, শিলা আমাকে ভুলে গেছে।

যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ি, মায়ের সঙ্গে নিউমার্কেটে গেছি, হঠাৎ ভেনেসিয়ার কাছে দেখি অ্যাপ্রোন পরা সাত–আটটা মেয়ে। এর মাঝে গাঢ় খয়েরি সালোয়ার–কামিজ, সেই পাতলা ঠোঁট, বড় বড় ডাগর চোখ, ভারী চশমায় কলকল করছে শিলা। আমি অভিমানে এগিয়ে গেলাম না। রিকশা ঠিক করে ওরা চলে গেল ঢাকা মেডিকেলে।

১৯৮৯ সালে হঠাৎ এক গভীর রাতে আমি যাকে চিঠি পোস্ট করতে দিয়েছিলাম, ও বলল দুটো চিঠির একটিও শিলাকে পোস্ট করেনি। স্রেফ দুষ্টুমির বশেই ও তা করেছিল। আমার তখন তীব্র কান্না পেল। তখনকার দিনগুলো এখনকার সময়ের মতো এত সহজ ছিল না। আমি ডিএমসিতে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) গিয়ে শিলাকে কীভাবে খুঁজে পাব, তা–ও বুঝতে পারছিলাম না।

মাসুদা চৌধুরী বা শিলাকে আমি ফেসবুকে খুঁজেছি, পাইনি। আমার জীবনে কোনো একক বন্ধুত্ব আজও গড়ে ওঠেনি। দলগত বন্ধু আছে। শিলার আসনটা আমি কাউকে দিতে চাইনি বলেই এভাবে কাটছে সময়। শিলা, আমি আবারও মাথার সঙ্গে মাথা লাগিয়ে নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় পড়তে চাই, ভীষণভাবে প্রতীক্ষা করি।

  • ফাতেমা রেজিনা ইকবাল, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়