সংস্কার কমিশন: পুলিশে দুর্নীতির ৯ খাত চিহ্নিত
পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের ৯টি খাত চিহ্নিত করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। ধীরে ধীরে নিয়োগ ও বদলি–বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ এসব দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি গত শনিবার পুলিশ সংস্কার কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন।
পুলিশে ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৪৫ হাজার লঘুদণ্ড ও ২৩ হাজার ৫৫০টি গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রের অন্যান্য অংশের মতো পুলিশও দুর্নীতিতে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত।
পুলিশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত দুর্নীতির চারটি খাত উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়ে থাকে, ‘আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা’; অর্থাৎ পুলিশ এতই ক্ষমতাবান যে কাউকে ফাঁসাতে চাইলে বা বাগে আনতে চাইলে তার হাতে কৌশল বা অস্ত্রের অভাব নেই।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যে ৯টি খাতে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এর মধ্যে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডভুক্ত দুর্নীতির ৫টি খাত রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘুষ গ্রহণ ও আর্থিক দুর্নীতি পুলিশের সবচেয়ে প্রচলিত ও দৃশ্যমান দুর্নীতির ধরন। সাধারণত থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ থেকে শুরু করে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার–বাণিজ্য, অভিযোগপত্র দায়ের, মামলায় হাজিরা থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতে বিচারিক মামলায় হাজিরাসহ মামলা নিষ্পত্তির বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতির দ্বিতীয় খাত হলো রিমান্ডে আসামি নির্যাতন। অভিযুক্ত আসামি বা আটক ব্যক্তিকে রিমান্ডে এনে নির্যাতনের ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় পুলিশের জন্য এক অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুর্নীতির অন্যতম খাত হিসেবে নিয়োগ ও বদলি–বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, পুলিশ পুলিশের কাছ থেকে ঘুষ নেয়, এটা জানতে হলে পুলিশের নিয়োগ ও বদলি নিয়ে রমরমা বাণিজ্য সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কনস্টেবল নিয়োগে ১০ লাখ টাকা বা ততোধিক ঘুষ নেওয়ার কথা শোনা যায়।
ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির কথাও উঠে আসে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ভুয়া বা গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার বা ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন পুলিশ সদস্যরা। নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সর্বশেষ ও পঞ্চম খাত হিসেবে ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অবৈধ মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, এমনকি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে পুলিশের কিছু অংশের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায়ই উঠে আসে।
দুর্নীতির আরও চার খাত
পুলিশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত দুর্নীতির চারটি খাত উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়ে থাকে, ‘আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা’; অর্থাৎ পুলিশ এতই ক্ষমতাবান যে কাউকে ফাঁসাতে চাইলে বা বাগে আনতে চাইলে তার হাতে কৌশল বা অস্ত্রের অভাব নেই।
প্রতিবেদনে পুলিশের চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, সড়ক–মহাসড়কে পুলিশের চাঁদাবাজি একটি দৃশ্যমান দুর্নীতি। পরিবহন খাতে এই চাঁদাবাজির টাকা ছাপানো স্লিপ বা কাগজ দিয়ে তোলা হয়।
ফুটপাত ব্যবসা বা ইনফরমাল সেক্টরের দুর্নীতির বিষয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষত ঢাকা-চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ফুটপাত দখল করে অবৈধ অস্থায়ী দোকানপাট বসিয়ে ব্যবসা করা একটি অতিপরিচিত অর্থনৈতিক খাত। পুলিশ সেখানে দৈনিক দোকানপ্রতি ভাড়া আদায় করে।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের মতে, বছরে এই চাঁদার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাত
প্রতিবেদনে অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশের আঁতাতকে দুষ্ট আঁতাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ সদস্যদের একাংশ অপরাধীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের কার্যক্রমে সাহায্য করে থাকে। বিনিময়ে পুলিশ তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নেয়। অবৈধ মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, এমনকি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে পুলিশের কিছু অংশের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায়ই উঠে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, কাউকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে আটক করা হয় এবং তাঁকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ক্রসফায়ার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলপূর্বক গুমের ঘটনা বৃদ্ধির সঙ্গে এ ধরনের অর্থ আদায় জনসমক্ষে পরিচিত হয়ে ওঠে। অবৈধ গৃহতল্লাশিতে পুলিশের লোক পরিচয়ে যায় এবং আটক ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন পর মুক্তিপণ আদায় করে দূরবর্তী স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সংস্কারের সুপারিশের ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ জনগণের দূরত্ব কমানো এবং সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। আর এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ জন্য দুর্নীতির খাতগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধে স্থানীয় মানুষদের নিয়ে কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে।পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন
দুর্নীতি প্রতিকারের সুপারিশ
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুটি সুপারিশ করা হয়। একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন, অপরটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন। সর্বদলীয় কমিটির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি থানা/উপজেলায় একটি সর্বদলীয় কমিটি গড়ে তোলা যায়, যারা স্থানীয় পর্যায়ে ওভারসাইট বডি হিসেবে কাজ করবে।
বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে সুপারিশে বলা হয়, পুলিশের দুর্নীতি হঠাৎ উঠে যাবে না। একে ধীরে ধীরে সমূল উৎপাটন করতে হবে। এ জন্য দরকার প্রবল নাগরিক আকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
জানতে চাইলে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংস্কারের সুপারিশের ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ জনগণের দূরত্ব কমানো এবং সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। আর এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ জন্য দুর্নীতির খাতগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধে স্থানীয় মানুষদের নিয়ে কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে।’