একাত্তরে প্রতিদিন যা ঘটেছে

যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারাছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে

আচ্ছা, একাত্তর সালের পরে যে প্রজন্মের জন্ম, মুক্তিযুদ্ধের ছবিটা তাঁদের মনে কীভাবে আঁকা? ধরা যাক, জন্মের আগে ঘটে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চিত্র আমাদের মনে যেভাবে আঁকা, অনেকটা তেমনই কি! যে ঘটনা আমরা চোখে দেখিনি, প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচা–মরার যে আতঙ্ক শিরদাঁড়ায় অনুভব করিনি, যে স্বপ্নের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জনও মনে হয়েছিল তুচ্ছ—ইতিহাসের নিরক্ত পৃষ্ঠায় তার তথ্য পাই ঠিকই, কিন্তু সে ঘটনার তীব্রতা বা উত্তাপ আমাদের গায়ে লাগে না।

প্রত্যক্ষ সেসব আবেগময় মুহূর্ত থেকে ইতিহাস আমাদের সরিয়ে নিয়ে আসে মস্ত একটা ফ্রেমে। উড়োজাহাজে বসে আকাশ থেকে দেখা জমির মতো সে কাহিনি তখন অনেক সুদূর, সুবিন্যস্ত আর একাকার দেখায়।

মুক্তিযুদ্ধের বিবরণে আমরা নির্মম গণহত্যার তথ্য পড়ি। পড়ি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত বীরত্বগাথা, শরণার্থীদের অনিশ্চিত জীবনের বর্ণনা, পরাশক্তিদের কূটনৈতিক টানাপোড়েনের কথা। বড় বড় বয়ানে হারিয়ে যায় ছোট ছোট খুঁটিনাটি। হারায় আরও একটা বিষয়। বিচিত্র লোকের অংশগ্রহণে একটির পর একটি দিনের পরম্পরায় কী করে কোনো বড় বয়ানের ঘটনাধারা ঘটে ওঠে তার ছবি।

মুক্তিযুদ্ধের বিপুল ঘটনাধারা প্রতিটি দিন ধরে ধরে লিপিবদ্ধ করার সেই অসাধারণ সুযোগই এনে দিল ২০২১ সাল। সেই সুবাদেই প্রকাশ করা গেল একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপির মতো একটি বই।

২০২১ সাল ছিল মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী। ২০২০ সাল থেকেই আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতক কী করে অর্থবহভাবে উদ্‌যাপন করা যায়। আরও বহু সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নানা বড় বড় উৎসবের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু করোনার অতিমারির প্রবল দুঃসময় অধিকাংশ আয়োজনের ভাবনাকে চাপা দিয়ে দেয়।

প্রথম আলোর কাজ প্রকাশনা। তাই আমাদের পরিকল্পনাও ছিল নানা রকমের প্রকাশনাকে ঘিরে। মুক্তিযুদ্ধের নিয়তিনির্ধারক দিবসগুলোতে তথ্যবহুল ক্রোড়পত্র, মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যায়ের ভূমিকা রাখা মানুষদের স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার, একাত্তর নিয়ে দেশি-বিদেশি গবেষকদের নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ—২০২১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বছরজুড়ে প্রকাশের পরিকল্পনা আমরা নিয়েছিলাম।

একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি
সম্পাদনা: সাজ্জাদ শরিফ প্রথমা প্রকাশন

আরও একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম। আমরা এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরির কথা ভেবেছিলাম, যা ক্রমে হয়ে উঠবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি তথ্যবহুল পূর্ণাঙ্গ অনলাইন মহাফেজখানা। সেখানে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় তথ্য, ছবি, দলিল, অডিও, ভিডিওসহ যা কিছু সম্ভব সবকিছু।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কৌতূহলী পাঠক থেকে অনুসন্ধানী গবেষক পর্যন্ত যে কেউ যেন এক সময়ে এই ওয়েবসাইটে এসে পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদ পেয়ে যেতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের একটি অনুপ্রেরণা নিয়ে ফিরে যেতে পারেন। ওয়েবসাইটটি (1971.prothomalo.com) আমরা সে বছরই অনেক আনন্দ নিয়ে উদ্বোধন করেছি। তবে এ ধরনের ওয়েবসাইটের কাজ তো কোনো দিনই শেষ হওয়ার নয়।

যে বইটির কথা বলছিলাম, তার কথায় ফিরি। আমরা ভাবলাম, ১৯৭১ সালের একেকটি দিনের তারিখ ধরে ধরে মুক্তিযুদ্ধকালে সেই দিনে ঘটা সব তথ্য আমরা সংগ্রহ করে সাজাব। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে তা প্রকাশিত হবে। কিন্তু দীর্ঘ নয়টি মাস পত্রিকার প্রথম পাতায় অমন মূল্যবান জায়গা পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? প্রস্তাব শুনে মতি ভাই—প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান—তৎক্ষণাৎ সম্মতি দিয়ে দিলেন।

তিনি তো সম্মতি দিলেন, বড় সমস্যাটা এল তার পরে। মুক্তিযুদ্ধ একটা বিরাট ঘটনা—বিপুলতায় ও তাৎপর্যে। ফলে ‘মুক্তিযুদ্ধ, এই দিনে’ শিরোনামের নিচে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনা সংকলন করা ছিল অসম্ভব দুরূহ একটি প্রকল্প। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক স্তরে অসংখ্য ব্যক্তি, সংগঠন, দল, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র যার যার মতো জড়িয়ে পড়েছিল।

ভারত তো প্রত্যক্ষভাবে ছিলই, স্নায়ুযুদ্ধের সেই আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়ল এশিয়ার শক্তিধর দেশ চীন। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, লেখক-শিল্পী, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা এ ঘটনায় নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ঘটনার স্রোত নানা দিক থেকে বইতে থাকে—কখনো সেসব সমন্বিত হয়, কখনো বিপরীতমুখী টানাপোড়েন তৈরি করে। আমাদের কাজ ছিল সেসব ঘটনা মিলিয়ে মিলিয়ে একেকটি তারিখের নিচে সাজানো।

মুক্তিযুদ্ধের পরে, গত অর্ধশতাব্দীতে, স্মৃতিকথাও কম লেখা হয়নি। দেশে-বিদেশে গবেষণাও হয়েছে যথেষ্ট। সেসব মন্থন করে এবং সে সময়ের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে তারিখ ধরে ধরে তালিকাবদ্ধ করা কারও একার কাজ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় কোনো গবেষক দলের সমবায়ে সাধারণত এ ধরনের কাজ হয়। সেসব ছাড়াই এ কাজটি আমরা করেছি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার জোরে। বিশেষ করে তথ্য গ্রন্থনার কাজে রাশেদুর রহমান সে সময় দিনরাত বিপুল শ্রম দিয়েছেন।

২০২১ সালজুড়ে যে ভালোবাসার শ্রম আমরা দিয়েছিলাম, তারই সংকলনবদ্ধ রূপ নিয়ে একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি বইটি প্রথমা প্রকাশন বিজয়ের এই মাসে বাজারে নিয়ে এল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু গবেষণাগ্রন্থ বেরিয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনাপঞ্জির তালিকা নিয়ে এ ধরনের কোনো বই আমাদের চোখে পড়েনি। বইটি বের করার সময় আমরা একটি নির্ঘণ্ট যুক্ত করে দিয়েছি, যাতে এর ব্যবহার সহজ হয়।

মুক্তিযুদ্ধের মতো মহাঘটনা নিয়ে গবেষণা হতেই থাকবে। কারণ, জাতি হিসেবে নিজেদের বুঝতে পারার এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে দেখতে চাওয়ার তাগিদ আমাদের থাকবে। সে কারণে হয়তো এ বইটি কাজে লাগবে।