শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ–বাণিজ্য 

  • অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি আ.লীগ নেতা।

  • নিয়োগে সংসদ সদস্যের সম্মতি নিয়ে আলোচনা।

  • অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগ–বাণিজ্য

প্রতীকী ছবি

১৯৯৪ সালে রংপুরের মিঠাপুকুরের মির্জাপুরে বছির উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক এম মতলুবর রহমান। প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখলেও এখন আলোচিত নিয়োগ–বাণিজ্য নিয়ে।

শুধু বছির উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ নয়, মিঠাপুকুরে বেসরকারি এমপিওভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণি, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ ব্যবস্থাপনা কমিটি যেসব নিয়োগ দিচ্ছে, সেগুলোতে প্রায়ই এমন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

মিঠাপুকুরে বেসরকারি এমপিওভুক্ত নিম্ন ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজ এবং দাখিল, আলিম ও ফাজিল মাদ্রাসা রয়েছে ১৬৭টি। জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত তিন বছরে মিঠাপুকুর উপজেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, ল্যাব সহকারী, আয়া, নৈশপ্রহরী ও নিরাপত্তাকর্মী পদে অন্তত দেড় শতাধিক নিয়োগ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এনটিআরসিএর (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (রংপুর–৫) এইচ এন আশিকুর রহমান ও তাঁর ছেলে রাশেক রহমানের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। এই ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে নিয়োগ–বাণিজ্যের নানা অভিযোগ রয়েছে। এ রকম ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম আলো সরেজমিন অনুসন্ধান করে অভিযোগের পক্ষে তথ্য–উপাত্ত পেয়েছে।

তবে সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়। ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ নিয়োগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটিই দেয়।

আরও পড়ুন

বছির উদ্দিন কলেজ

বছির উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে নিয়োগ–বাণিজ্যের প্রতিবাদে গত ৬ মে মিঠাপুকুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রতিষ্ঠানটির দাতা কমিটির সদস্য ও প্রয়াত মতলুবর রহমানের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আখেরুজ্জামান। আখেরুজ্জামানের অভিযোগ, গত জানুয়ারিতে এ কলেজে অফিস সহকারী, ল্যাব সহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে সাতজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে অধ্যক্ষ খন্দকার মুশফিকুর রহমান ও কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটি ‘নিয়োগ–বাণিজ্য’ করেছে।

মির্জাপুরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ। আরেক চাকরিপ্রার্থী নাজমুল ইসলামের দাবি, ল্যাব সহকারী (আইসিটি) পদে চাকরির আশ্বাস দিয়ে তাঁর কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন অধ্যক্ষ। উভয় চাকরিপ্রার্থীর দাবি, তাঁদের চাকরি হয়নি। যাঁরা বেশি টাকা দিয়েছেন, তাঁদের চাকরি হয়েছে। গত ২৩ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তদন্ত দল কলেজে এলে তাঁরা এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

কলেজের পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিলীপ কুমারের অভিযোগ, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর নতুন সৃষ্ট পদে তাঁর স্ত্রী কদমী রানীর জন্য অধ্যক্ষ মুশফিকুর রহমান অগ্রিম ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু কদমীর চাকরি হয়নি।

তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাণিজ্য হয়নি বলে দাবি করেন অধ্যক্ষ খন্দকার মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, দিলীপ কিছু টাকা নিয়ে এসে তাঁর স্ত্রীর চাকরি চেয়েছিলেন। কিন্তু টাকাসহ তাঁকে ফেরত দেওয়ায় এখন অপপ্রচার করছেন। আর জাহাঙ্গীর ও নাজমুলের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চিত্র

রুপসী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত ২৩ মে। এতে অনেকেই আবেদন করেছেন। নিয়োগপ্রক্রিয়া এখনো চলমান। এরই মধ্যে কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে প্রধান শিক্ষক রেজাউল হক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ২৫ জুলাই আয়া ও অফিস সহায়ক পদে দুজন চাকরিপ্রার্থীর পরিবারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। পরিবার দুটি জানায়, চাকরির জন্য দুজনে তিন লাখ টাকা করে প্রধান শিক্ষককে দিয়েছেন। 

আরেক চাকরিপ্রার্থীর বাবা রুপসী নাপিতপাড়া গ্রামের সামছুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলে সেলিম মিয়াকে ল্যাব সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রধান শিক্ষক ছয় লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যালয়ে ল্যাব সহকারী পদ অনুমোদন হয়নি। টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।

প্রধান শিক্ষক রেজাউল হক দাবি করেন, কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লেনদেন আছে। তবে নিয়োগের নামে টাকা নিয়েছেন, এ অভিযোগ ঠিক নয়।

গত ১৫ জানুয়ারি মৌলভীগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় চারটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি খোঁড়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. আসাদুজ্জামান। তাঁর বিরুদ্ধে চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এর মধ্যে আয়া পদে চাকরির জন্য পদাগঞ্জ পশ্চিমপাড়া গ্রামের মমতাজ বেগম চার লাখ, মোস্তনা বেগম এক লাখ ও তামান্না আক্তার সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দেন বলে তাঁরা প্রথম আলোকে জানান। আসাদুজ্জামান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তামান্নার স্বামী সানজু মিয়ার সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক লেনদেন রয়েছে। মোস্তনা তাঁকে টাকা দিতে চাইলেও তিনি নেননি। মমতাজকে তিনি চেনেন না।

সংসদ সদস্যের অনুমতিতে নিয়োগ

কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে তাঁরা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে জানালে তিনি সংসদ সদস্য আশিকুর রহমান অথবা তাঁর ছেলে রাশেক রহমানের সম্মতি নিতে বলেন।

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহেদুল ইসলাম গত ২৬ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্য এলাকার যোগ্য লোকদের চাকরি দিতে চান। এ কারণে তিনি সংসদ সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। 

তবে সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান বলেন, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি নিয়োগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। যাঁরা নিয়োগ পান না, তাঁরাই নিয়োগ–বাণিজ্যের কথা বলেন। 

আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমানও প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগে তাঁদের কোনো নির্দেশনা নেই। তবে তাঁদের চাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো অপরাধী বা জামায়াত-শিবিরের লোকজন নিয়োগ না পান।

রাধাকৃষ্ণপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বিপ্লব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৫ নভেম্বর অফিস সহকারীসহ চারটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করলে তিনি রাশেক রহমানের অনুমতি নিতে বলেন। এরপর তিনি রাশেক রহমানের সঙ্গে ঢাকা ও মিঠাপুকুরে একাধিকবার যোগাযোগ করেন। তবে রাশেক রহমান দাবি করেন, তিনি বিপ্লবকে চেনেন না।  

বিপ্লব মিয়া জানান, একপর্যায়ে এই নিয়োগ নিয়ে তাঁরা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। পরবর্তী সময়ে ৫ জুন নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়। এর আগের দিন ৪ জুন বিপ্লব ও প্রধান শিক্ষক আবদুল বারীকে একটি মারামারির ঘটনায় আসামি করা হয়। বাড়িতে পুলিশ গেলে তিনি এলাকাছাড়া হন। পরদিন আর নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি। প্রধান শিক্ষক আবদুল বারীও একই তথ্য জানান।