রঙের ব্যবসা ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে

দেয়ালে রঙের নান্দনিক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। মডেল: সারিকা সাবা
ছবি: কবির হোসেন

মানুষের রুচির পরিবর্তন ও নগরায়ণের ফলে দেশে রংশিল্পের বিকাশ ঘটেছে খুব দ্রুত। ১৯৫২ সালে এলিট পেইন্টের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা এই খাতের ব্যবসা এখন বছরে ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান রং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে কয়েক বছর ধরে সংকটে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে এ দেশে যাত্রা শুরু করে বহুজাতিক কিছু রংশিল্প প্রতিষ্ঠান। তারা একের পর এক রং বাজারে আনতে শুরু করে। এসব রঙের বৈচিত্র্য মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। এর মধ্যে দেশি রঙের প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। মূলত দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো রংশিল্পের বাণিজ্যিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। এখন বেকারত্ব কমানোর পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি হয়েছে এই শিল্পে।

বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, বাংলাদেশে ৩৬টির মতো নিবন্ধিত দেশি কোম্পানি রং উৎপাদন করে। এর বাইরেও বেশ কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্তমানে রংশিল্পের বাজারের আকার ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর দেয় রং উৎপাদক কোম্পানিগুলো। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ রঙের চাহিদা মেটান দেশি রং উৎপাদকেরা। এর বাইরে আরও কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। 

বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অরুণ মিত্র প্রথম আলোকে জানালেন, একসময় মাটি ও কাঠের ঘরের আধিপত্য ছিল। এখন বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে উঠছে। এ কারণে রংশিল্প খাত প্রসারিত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পণ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে মাথাপিছু রঙের হার ১ দশমিক ৪ কেজি। এটি ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর চেয়ে কম।

ব্যবসার শুরুটা যেভাবে

এই অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম রং বা পেইন্টিং কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে এলিট পেইন্টের হাত ধরে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত সিরাজউদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন ছোট পরিসরের কারখানা। শুরু হয় উৎপাদন। এরপর ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে ব্যবসা। 

এলিট পেইন্টের পর ১৯৫৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে রক্সি পেইন্টস। এরপর একে একে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে পেইলাক পেইন্ট, মুন স্টার, আল করিম পেইন্টস, উজালা পেইন্ট, বার্জারসহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। 

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, বার্জার পেইন্টস প্রথম চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কারখানা চালু করে। পরে ঢাকায়ও করা হয়। স্বাধীনতার পর অলিম্পিক পেইন্ট (আগে ইস্টার্ন কেমিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড), বাক্সলী পেইন্টস, আল হোসাইন পেইন্টস, আল করিম পেইন্টস, রনি কেমিক্যালস, মনিলাক পেইন্টস, মৌসুমি পেইন্টস, নাফি পেইন্টস, আইডিয়াল পেইন্টস ব্যবসা শুরু করে। এর মধ্যে রনি কেমিক্যালস, মৌসুমি পেইন্টস, নাফি পেইন্টস, আইডিয়াল পেইন্টসহ কয়েকটির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। 

বাজারের নেতৃত্ব যাদের হাতে 

রঙের বাজারে মূলত দখল রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। এসব কোম্পানি ৯০ শতাংশ বাজারের অংশীদার। বাকি ১০ শতাংশ দেশীয় কোম্পানির দখলে। 

৫৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে শীর্ষে আছে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ। বহুজাতিক এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৭৬০ সালে। জার্মান নাগরিক লুইস বার্জারের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ‘রঙের-জগৎ’। ১৭৬০ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে তিনি রাসায়নিক ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এরপর ইতিহাসের আলপথ ধরে বার্জার এসে পৌঁছায় এই ভূখণ্ডে, বাংলাদেশে। স্বাধীনতার আগে থেকে তারা ব্যবসা শুরু করে। সালটা ১৯৭০। সে বছর চট্টগ্রামে প্রথম কারখানা স্থাপন করা হয়। তবে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ নামে কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। ১৯৯৯ সালে তারা সাভারে একটি বড় কারখানা করে। ২০০৫ সালে বার্জার পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত হয়।

জানতে চাইলে বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বার্জার বাজারের ৫৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে। তবে অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় এই খাতে চাহিদাও কিছুটা কমেছে। আর চাহিদা কমায় সার্বিকভাবে ব্যবসা কিছুটা মন্দা যাচ্ছে। ক্রেতারা এই খাতে খরচ কমাচ্ছেন। অর্থনীতির চাকা গতিশীল হলে রংশিল্পও ঘুরে দাঁড়াবে। 

বার্জারের পরে রয়েছে এশিয়ান পেইন্টস। ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এশিয়ান পেইন্টস দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। ২০০২ সালে কনফিডেন্স সিমেন্টের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য রং উৎপাদন করতে যাত্রা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে গ্রাহকদের সব রঙের চাহিদা মেটাতে উন্নত প্রযুক্তি আর উচ্চ পারফরম্যান্স ডেকোরেটিভ, মেরিন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেইন্ট পণ্য প্রস্তুত ও বিতরণ করছে।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতিবছর গাজীপুর কারখানায় ২৫ হাজার কিলোলিটারের বেশি রং উৎপাদন করা হচ্ছে। এ ছাড়া মিরসরাইয়ে নতুন কারখানায় বছরে ৩০ হাজার কিলোলিটার রং উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

রঙের বাজারে আরেক পুরোনো কারবারি এ্যাকোয়া পেইন্টসের গল্প এবার শোনা যাক। ১৯৫২ সালে ‘কুমির মার্কা আলকাতরা’ নামের একটি রঙের ব্র্যান্ড চালু হয়েছিল। সেখান থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক যাত্রা শুরু, যা পূর্ণতা লাভ করে ২০০১ সালের দিকে। সে বছর ঢাকার অদূরে টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় রং উৎপাদনে কারখানা তৈরি করেন ব্যবসায়ী রামজুল সিরাজ। 

প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রংশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল রেজিন ও ইমালশন উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে রঙের বাজারে এ্যাকোয়া রেজিন ও ইমালশন নামে পরিচিতি পেয়েছে। 

এ্যাকোয়া পেইন্টসের পরিচালক শায়ান সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানের রং উৎপাদন করায় প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। উৎপাদন পর্যায়ে বিশেষায়িত কাঁচামাল ও বিভিন্ন ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করার কারণেই এই সুনাম। 

এই শিল্পের নবীন সদস্য রেইনবো পেইন্টস। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। এই চার প্রতিষ্ঠানের বাইরে এলিট পেইন্ট, নেদারল্যান্ডসের একজোনোবেল, জাপানের নিপ্পন, নরওয়ের জয়তুন পেইন্টসের রং গ্রাহকের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। 

তবু সংকট

ব্যবসা সম্প্রসারিত হলেও কয়েক বছর ধরে এই খাত সংকটে রয়েছে। এ জন্য কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করছেন উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, এ খাতের ৯৮ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। আমদানির খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এ কারণে দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। 

অরুণ মিত্র প্রথম আলোকে বললেন, কয়েক বছর ধরে এমনিতেই এই খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে স্থানীয় রং উৎপাদকদের ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবার অবকাঠামো নির্মাণের হারও কমেছে। কয়েক বছর আগেও রংশিল্পে বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। এখন সেটি ৬ শতাংশে নেমেছে। তবে অর্থনীতি ভালো অবস্থানে গেলে এই খাত ঘুরে দাঁড়াবে।