দেশেই ক্যানসার-চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা
সম্মিলিতভাবে কাজ করলে আরও সফলভাবে ক্যানসার মোকাবিলা সম্ভব
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগ ও চিকিৎসা নিয়ে যে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ছিল, তা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সবাই মিলে কাজ করলে ক্যানসার মোকাবিলা আরও সফলভাবে করা সম্ভব।
এসকেএফ অনকোলোজি আয়োজন করে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় এ কথা উঠে আসে।
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড কিডনি ক্যানসার ডে’। এ বছর দিনটি পালিত হয় ১৯ জুন। এই বিশেষ দিবস ঘিরে সবার মধ্যে ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে শনিবার (২১ জুন) ওই অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন। অতিথি হিসেবে ছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ও চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. এ টি এম কামরুল হাসান।
এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘রেনাল সেল কার্সিনোমা’। বাংলাদেশে কিডনি ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, ডায়াগনোসিস, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সচেতনতা, প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. এ টি এম কামরুল হাসান। পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন বলেন, ‘কিডনি ক্যানসার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো ও রোগ শনাক্তকরণে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এ দিবসের উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে জুন মাসজুড়ে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় “ন্যাশনাল ক্যানসার সারভাইভার মান্থ”, যা ক্যানসার জয় করে বেঁচে থাকা লাখো মানুষকে সম্মান জানানো এবং তাদের সাহস ও সংগ্রামের গল্প তুলে ধরার একটি সুযোগ।’
‘ক্যানসার সারভাইভার মান্থ’ প্রসঙ্গে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘ক্যানসার নিয়ে মোটামুটি আমরা সবাই এখন সচেতন। ক্যানসারের যুদ্ধ সেই দীর্ঘ পরিক্রমা—অর্থাৎ রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত। এই সময়টাতে রোগী শারীরিক, মানসিক ও মানবিক বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে যায়। চিকিৎসার পর যত দিন পর্যন্ত রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, তত দিন তাঁর মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। এ সচেতনতা সবার মধ্যে তুলে ধরতেই পালিত হয় ক্যানসার সারভাইভার মান্থ।’
ক্যানসার সারভাইভার হিসেবে কাদের ধরা হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘একজন রোগী যখন চিকিৎসা শুরু করেন, তখন থেকেই তাঁকে ক্যানসার সারভাইভার হিসেবে ধরা হয়। কারণ, তখন থেকেই তিনি আমাদের সারভাইভারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় চলে আসেন। এই প্রোগ্রাম পুরো চিকিৎসাজুড়ে রোগীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য তৈরি। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন, আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারেন কিংবা ক্যানসার ছড়িয়ে যেতে পারে—তিন ক্ষেত্রেই তিনি সারভাইভারশিপ কাঠামোর অংশ। এমনকি “পেলিয়েটিভ কেয়ারের” মাধ্যমে কষ্ট লাঘব করাও এই ধারার মধ্যে পড়ে।’
ক্যানসারের সঙ্গে সারভাইভ করার হারে প্রতিবছর বাংলাদেশ কী ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়? জানতে চাওয়া হলে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্যানসার রোগ ও চিকিৎসা নিয়ে যে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ছিল, তা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আগে ক্যানসার মানেই মানুষ ধরে নিত মৃত্যু অনিবার্য। আজও রোগীরা আসেন এবং বলেন, পাশের বাড়ির লোক বলেছে কেমোথেরাপি নিলে আর বাঁচা যাবে না। কিন্তু এখন সেই মানসিকতা থেকে আমরা অনেকটাই বের হয়েছি।’
ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ক্যানসার চিকিৎসায় এসেছে পদ্ধতিগত পরিবর্তন, রোগীদের মানসিকতায় এসেছে সাহস ও সচেতনতা। এখন রোগীরা নিজেরাই চিকিৎসা নিতে আসছেন। ক্যানসার এখন চিকিৎসাযোগ্য—এটা মানুষ বিশ্বাস করতে শিখছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন প্রায় সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে। সার্জিক্যাল, মেডিকেল, রেডিয়েশনসহ সীমিত রিসোর্সে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এই বার্তাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানো খুব জরুরি।’
এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ডা. কামরুল হাসান বলেন, ‘গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সবাই মিলে কাজ করলে ক্যানসার মোকাবিলা আরও সফলভাবে করা সম্ভব।’
এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান ‘রেনাল সেল কার্সিনোমা’ সম্পর্কে। উত্তরে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘রেনাল সেল কারসিনোমা মানে কিডনির ক্যানসার। যদিও এ সম্পর্কে অনেকের পরিষ্কার ধারণা নেই। এ ধরনের ক্যানসার হলে অনেকেই ধরে নেন কিডনি নষ্ট হয়ে যাবে, ট্রান্সপ্ল্যান্ট লাগবে বা ডায়ালাইসিস করতে হবে। অথচ এটি একটি নিরাময়যোগ্য ক্যানসার। এমনকি চতুর্থ ধাপেও প্রায় ৫০ শতাংশ রোগী ভালোভাবে সাড়া দেন। ইউরিন ইনফেকশন বা কিডনি ফেইল নিয়ে মানুষ যতটা সচেতন, কিডনির ক্যানসার নিয়ে ততটা নয়। অথচ সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে এই ক্যানসার সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
কিডনি ক্যানসারের উপসর্গ সম্পর্কে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘কিডনির ক্যানসারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ রোগীর স্পষ্ট কোনো লক্ষণ থাকে না। মাত্র ১০ শতাংশের পেটে ভারী ভাব, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত অথবা পেটে কিছু গেঁথে থাকা অনুভূত হয়। অনেক সময় পেটের ব্যথা বা অন্য সমস্যায় পরীক্ষা করানোর সময়ই কিডনির ক্যানসার ধরা পড়ে।’
কিডনি ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘সাধারণত এটি হওয়ার পেছনে দুই রকম কারণ থাকে। একটি বংশগত, অন্যটি পরিবেশগত। সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, তা হলো “ক্লিয়ার সেল রেনাল সেল কারসিনোমা”, যা কিডনি ক্যানসারে আক্রান্তদের প্রায় ৮৫ শতাংশেরই পাওয়া যায়।’
কিডনি ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা কাদের বেশি? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘কিডনি ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি মূলত ধূমপায়ীদের। এতে থাকা নিকোটিন ও কারসিনোজেন এই রোগের প্রধান কারণ। এ ছাড়া বংশগত কারণেও কিছু কিডনি ক্যানসার হয়। আর যাঁরা হাইপারটেনশনে ভুগছেন, নিয়মিত প্রেশার কন্ট্রোলে রাখতে না পারলে তাঁদের মধ্যে কিডনি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে যাঁরা প্রেশারের ওষুধ ঠিকমতো গ্রহণ করেন না, তাঁরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অন্যদিকে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা ডায়ালাইসিসের রোগীদের মধ্যেও কিডনি ক্যানসারের আশঙ্কা রয়েছে। ডায়াবেটিসের মতো রোগও কিডনি ফেলিউরের কারণ হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে কিডনি ক্যানসার দেখা দিতে পারে। তবে আশার কথা হলো, শিশুদের মধ্যে হওয়া কিডনি ক্যানসার (নেফ্রোব্লাস্টোমা) সাধারণত চিকিৎসাযোগ্য এবং শুরুতেই সঠিকভাবে শনাক্ত করলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।’
রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘কিডনি ক্যানসার শনাক্তকরণে প্রথম ধাপে রক্ত পরীক্ষা এবং কিডনির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে হয়। কিডনিতে টিউমার আছে কি না, তা বোঝার জন্য আলট্রাসোনোগ্রাফি করা হয়, যা খুবই কার্যকর একটি পদ্ধতি। এ ছাড়া টিউমারের সঠিক সাইজ ও ছড়িয়ে পড়ার মাত্রা নির্ধারণ করতে কন্ট্রাস্টসহ সিটি স্ক্যান করা হয়। এরপর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ডায়াগনোসিসের জন্য সিটি গাইডেড কোর বায়োপসির মাধ্যমে টিউমারের নমুনা নিয়ে ক্যানসার নিশ্চিত করা হয়।’
কিডনি ক্যানসারের স্টেজিংয়ের সঙ্গে চিকিৎসা-পদ্ধতির কোনো সম্পর্ক আছে কি না? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘কিডনি ক্যানসারের চিকিৎসায় স্টেজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিকভাবে “স্টেজ-১ ও ২”-এ সাধারণত শুধু সার্জারি করলেই রোগী সুস্থ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কিডনির আক্রান্ত অংশ অপসারণ করা হয়। তবে অগ্রসর স্টেজ বা “স্টেজ-৩ ও ৪”-এ সার্জারি সঙ্গে কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপির প্রয়োজন পড়ে। তবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কারণে রোগীরা ইমিউনোথেরাপির চাইতে টার্গেটেড থেরাপি বেশি দিয়ে থাকেন। তবে উভয় থেরাপি একসঙ্গে দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।’
কিডনি চিকিৎসায় সাইড ইফেক্ট প্রসঙ্গে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান বলেন, ‘কিডনি ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপিতে সাধারণত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম দেখা যায়। তবে ইমিউনোথেরাপিতে সাধারণ সাইড ইফেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে শারীরিক দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য, হালকা হেপাটাইটিস এবং সংক্রমণের ঝুঁকি। তবে বেশির ভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই ম্যানেজ করা সম্ভব। তাই চিকিৎসকেরা এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখেন।’
কিডনি ক্যানসারের সারভাইভাল রেট সম্পর্কে ডা. এ টি এম কামরুল হাসান জানান, এতে বাঁচার হার এখন অনেক বেশি। রেনাল সেল কার্সিনোমা (আরসিসি) বা কিডনি ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির কারণে রোগীদের বেঁচে থাকার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আগে যেখানে এই রোগে মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি, এখন প্রায় ৫০ শতাংশ রোগী পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকছেন। এটি চিকিৎসার বড় একটি সাফল্য। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যেকোনো ক্যানসারের মতো আরসিসিও ফেরত আসতে পারে। তাই নিয়মিত ফলোআপ ও রুটিন চেকআপ অত্যন্ত জরুরি।’