সেই ‘আলিফের আম্মু’ প্রফেশনাল মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টার ফাইনালে নবম, আলিফ দ্বিতীয় হয়েছেন

ক্লাসে মুকসেতুল ইসলাম ওরফে আলিফ ও তাঁর মা জুলিয়া আইরিনছবি: সংগৃহীত

জুলিয়া আইরিন ও তাঁর ছেলে মুকসেতুল ইসলাম ওরফে আলিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে ‘প্রফেশনাল মাস্টার্স’ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ছয় মাসের মাথায় প্রথম সেমিস্টার ফাইনালে সিজিপিএ ৪ এর মধ্যে ছেলে ৩ দশমিক ৯৪ পেয়ে দ্বিতীয় এবং মা ৩ দশমিক ৪৪ পেয়ে নবম হয়েছেন। এই মায়ের বয়স ৪৮ বছর আর ছেলের বয়স ২৬ বছর।

১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন জুলিয়া আইরিন। স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার পর তাঁর প্রথম সন্তান আলিফের জন্ম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী-বন্ধু-পরিচিতজনেরা তখন জুলিয়াকে ‘আলিফের আম্মু’ বলে ডাকা শুরু করেন।

আলিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) করেছেন। তবে তিনি একই বিভাগে নিয়মিত স্নাতকোত্তরে (মাস্টার্স) ভর্তি হননি। পরে এই মা ও ছেলে একসঙ্গে গত বছরের জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে প্রফেশনাল মাস্টার্সে ভর্তি হন। মা ও ছেলের নতুন পরিচয়, তাঁরা এখন সহপাঠী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে মা জুলিয়া আইরিন ও ছেলে মুকসেতুল ইসলাম ওরফে আলিফ
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার ফল নিয়ে জানতে চাইলে জুলিয়া আইরিন প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে একটুর জন্য প্রথম স্থান পায়নি। তাই মা ও ছেলে দুজনেরই মন খারাপ। অন্যদিকে মা ও ছেলে দুজনই ভালো ফল করার জন্য পরিবারের সদস্য, বন্ধু-স্বজন, বিভাগের শিক্ষকসহ সবাই খুব খুশি।

পড়াশোনায় মা ও ছেলের মধ্যে প্রতিযোগিতা কেমন ছিল জানতে চাইলে জুলিয়া আইরিন বলেন, ‘একটা কোর্সে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। কীভাবে আমি এত নম্বর পেলাম, তা জানার জন্য ছেলে শিক্ষকের কাছে গিয়ে আমার খাতা দেখতে চায়। পরে বলে, আমি নাকি আসলেই অনেক ভালো লিখেছি। ক্লাসে আমি প্রথম বেঞ্চে বসি, ছেলে আমার সঙ্গে বসতে চায় না। সে বসে পেছনের বেঞ্চে। মা ও ছেলে দুজনের একসঙ্গে পড়ার সময় না মেলায় আলাদা আলাদাভাবে পড়াশোনা করি। তবে সে যা পড়ে আর আমি যা পড়ি পরে তা নিয়ে আলোচনা করি। ছেলের হেল্প তো আমার লাগেই।’

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে আরও নতুন ছেলে–মেয়ে পেয়েছেন উল্লেখ করে জুলিয়া বললেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া আরেক ছেলের নাম শেখ শামস জুবায়ের। তার সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করি।’

প্রায় দেড় যুগ ধরে আইন পেশায় যুক্ত আছেন জুলিয়া আইরিন
ছবি: সংগৃহীত

জুলিয়া আইরিন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। এ পেশায় ১৮ বছরে পা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করার পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এলএলবি করেন জুলিয়া। ২০০৮ সালে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন।

জুলিয়া এখন সংসার-পেশা-পড়াশোনা সব সামলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ভালো ফল করায় সবার প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘আমার এ ফলাফল জানার পর থেকে আমার স্বামী আমি বিদেশ গিয়ে পিএইচডি করছি সে স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন।’

জুলিয়া জানান, তাঁর মাস্টার্সের ক্লাসে মোট ৪০ জন শিক্ষার্থী। কারও কারও বয়স তাঁর থেকেও বেশি। দুজন আছেন সম্পর্কে স্বামী ও স্ত্রী। তবে মা ও ছেলে আর কেউ নেই। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ তাঁকে আন্টি ডাকেন, কেউ কেউ আপু ডাকেন। আপু ডাকার সূত্রে আলিফকে কেউ কেউ ভাগনেও ডাকেন।

এই মা ও ছেলে শুক্র ও শনিবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ক্লাস করেন। জুলিয়া জানান, গত ছয় মাসের মধ্যে শুধু এক দিন জ্বরের জন্য ক্লাসে যেতে পারেননি। এ ছাড়া কোনো ক্লাস বাদ দেননি। এখন আর তাঁর ছুটির দিন বলে কিছু নেই। ফলে পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না। চলতি বছরের ডিসেম্বরে মা ও ছেলের মাস্টার্স শেষ হবে।

নব্বইয়ের দশকে ছেলে মুকসেতুল ইসলাম ওরফে আলিফকে কোলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে জুলিয়া আইরিন
ছবি: সংগৃহীত

আলাপে জুলিয়া ফিরে গেলেন সেই নব্বইয়ের দশকে। খুলনার মেয়ে জুলিয়ার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের ১০ দিনের মাথায়। বিয়ের পর জুলিয়া খুলনা থেকে ঢাকায় তাঁর স্বামী মো. মিজানুল ইসলামের বাড়িতে চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। ১৯৯৬ সালে অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনালের মৌখিক পরীক্ষার এক দিন পরই ছেলের জন্ম হয়। আর মাস্টার্স পরীক্ষার সময় তাঁর গর্ভে ছিল সাত মাসের মেয়ে। তিনি বলেন, ‘সন্তান গর্ভে নিয়ে এবং জন্মের পর ছেলেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। তখন আলিফ ছোট হাত দিয়ে আমার হাত ধরে হাঁটত। এখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই মাঝে মাঝে আমি আমার ছেলের হাত ধরে হাঁটি।’

জুলিয়ার মেয়ে তাসনিম বিনতে ইসলাম শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া বিভাগে স্নাতকে পড়ছেন। জুলিয়ার স্বামী মিজানুল রাজধানীর একটি স্কুলের ক্রীড়া বিভাগের প্রধানের পদে আছেন।

পুরো ইংরেজিতে পড়াশোনা করাটাকে প্রথম দিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই মনে করতেন জুলিয়া। এখন এ ভীতি অনেকটাই কমে গেছে। বিভাগের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে শিক্ষকদের আন্তরিক ব্যবহারের পাশাপাশি তাঁরা খুব ভালো পড়ান, এ কথা উল্লেখ করে শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন জুলিয়া। সেমিস্টার ফাইনালে আর একটু ভালো ফল আশা করেছিলেন বলেও জানালেন তিনি।

পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে জুলিয়া আইরিন
ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের ১১ জুলাই প্রথম আলো অনলাইনে ‘সেই “আলিফের আম্মু” মাস্টার্সে আলিফের সহপাঠী হচ্ছেন’ শিরোনামে এই মা ও ছেলেকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

শ্বশুর-শাশুড়িসহ যৌথ পরিবারে থাকেন জুলিয়া। তিনি বলেন, আগে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তখন সংসারসহ সবকিছুই সামাল দিতে হয়েছে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, তখন তিনি পড়তে বসতেন। ফলে তাঁকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে সেই যাত্রায় স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়িসহ সবার সমর্থন পেয়েছেন। নিজের বাবা ও মায়ের বয়স হওয়ায় এখন এই দুজনের দেখাশোনা করা ও খোঁজখবর নিতে হয়। তাই এখনো পড়ার জন্য আলাদা করে সময় বের করাটা কঠিন হয়ে যায় মাঝেমধে৵। তবে সব সামলেই এগিয়ে চলেছেন।

জুলিয়া বলেন, অনেকেরই পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকে; কিন্তু বয়স হয়ে গেছে, এ কথা চিন্তা করে অনেকেই আবার নতুন করে শুরু করতে ভয় পান। জুলিয়া বলেন, ‘আমি যেহেতু পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছি এবং ভালো ফলও করেছি, তাই ভয়ের কিছু নেই। কেউ চাইলেই আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করে স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন।’