মফস্‌সলে ১৮ সমস্যার মধ্যে কাজ করেন চিকিৎসকেরা

কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জগুলো চিকিৎসকেরা চিহ্নিত করেছেন বিস্তারিতভাবে। এসব সমস্যা দূর করতে পারলে মফস্‌সলে চিকিৎসকদের উপস্থিতি বাড়বে।

মফস্‌সলে চিকিৎসকদের নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে তাঁরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না; নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কর্ম–এলাকায় চিকিৎসকদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার ভালো সুযোগ পায় না। নারী চিকিৎসকেরা যথাযথ সম্মান পান না। জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে নোংরা পরিবেশে কাজ করতে হয়।

গ্রামাঞ্চলে বা ছোট শহরে কাজের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা এমন ১৮ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। এসব কারণে চিকিৎসকেরা মফস্‌সলে থাকতে চান না। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ বলছেন, এসব সমস্যার সমাধান না করলে হাজারো চেষ্টায় সরকার গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক ধরে রাখতে পারবে না।

সাক্ষাৎকার নেওয়া চিকিৎসকদের গড় বয়স ৩১ বছর। তাঁদের মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, বাকিরা নারী। তাঁদের মধে৵ ৩২ জন পরিবার নিয়ে কর্মস্থলে থাকেন, বাকি ১৯ জন একা থাকেন।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক–সংকটের কারণ ও সমাধান নিয়ে গত পাঁচ–ছয় বছরে বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। বর্তমান গবেষণাটি গত ১৭ মার্চ প্রসিদ্ধ চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট–এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাটি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের ছয়জন শিক্ষক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা শাখার এক কর্মকর্তা। গবেষণায় ৮ বিভাগের ৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৭টি উপজেলা হাসপাতালের ৫১ চিকিৎসা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০২১ সালের মার্চ ও এপ্রিলে। গবেষণায় যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা শাখা ও বিএসএমএমইউ।

সাক্ষাৎকার নেওয়া চিকিৎসকদের গড় বয়স ৩১ বছর। তাঁদের মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, বাকিরা নারী। তাঁদের মধে৵ ৩২ জন পরিবার নিয়ে কর্মস্থলে থাকেন, বাকি ১৯ জন একা থাকেন।

গবেষকদের একজন ও বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে বা ছোট শহরে চিকিৎসকেরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, আমরা তা শনাক্ত করতে পেরেছি। কাজের পরিবেশ, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসকদের সার্বিকভাবে ভালো থাকার ব্যাপারে নীতি ও কৌশল গ্রহণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।’

এসব চাপের কারণে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। অনেক সময় রোগীর আত্মীয়রা চিকিৎসকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তাঁদের কাছ থেকে গালাগাল শুনতে হয়, অনেক সময় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন চিকিৎসকেরা।

অবকাঠামোগত দুর্বলতা

প্রায় সব সরকারি উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে অবকাঠামোগত সমস্যার কথা বলেছেন চিকিৎসকেরা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্থানস্বল্পতা। রোগী দেখার কক্ষগুলো ছোট, এক কক্ষে একাধিক চিকিৎসককে বসতে হয়, রোগী দেখার সময় গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়স্বজনের ভিড় অনেক বেশি থাকে।

চিকিৎসকেরা বলেছেন, হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ প্রয়োজনমতো থাকে না, যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকে। ওষুধ সরবরাহে ঘাটতি থাকে। রোগী ও চিকিৎসকদের ব্যবহারের মতো পর্যাপ্ত পানি ও বিদ্যুৎ থাকে না। চিকিৎসকদের সহায়তাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা দেখা যায়। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতির কারণে চিকিৎসকদের ওপর বাড়তি কাজের চাপ পড়ে। হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি থাকায় চিকিৎসকদের নোংরা পরিবেশে কাজ করতে হয়।

সমস্যাগুলো পুরোনো, বহুল আলোচিত। কিন্তু সুরাহার জন্য আন্তরিক উদ্যোগ কেউ কখনো নেননি। সব সময় চিকিৎসকের দোষই ধরা হয়। কিছু সমস্যা দূর করতে স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল

প্রভাবশালীদের চাপ

হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসকেরা সব সময় স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চিকিৎসকদের কাজে বাধা দেন, নানা অনৈতিক চাপ দেন। এই তালিকায় স্থানীয় সাংবাদিকেরাও আছেন।

এসব চাপের কারণে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। অনেক সময় রোগীর আত্মীয়রা চিকিৎসকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তাঁদের কাছ থেকে গালাগাল শুনতে হয়, অনেক সময় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন চিকিৎসকেরা।

আবাসন সমস্যা

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯ চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন না। এর মধ্যে ১৭ জনই উপজেলা পর্যায়ের। অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের আবাসন সমস্যা বেশি। চিকিৎসকেরা গবেষকদের বলেছেন, থাকার ব্যবস্থা খারাপ।

চিকিৎসকদের অভিযোগ, কর্ম–এলাকায় তাঁদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভালো সুযোগ নেই। তাঁরা যে এলাকায় কাজ করেন, সেই এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থাও খারাপ।

নীতি–সম্পর্কিত সমস্যা

সাক্ষাৎকার দেওয়া ৫১ চিকিৎসকই বলেছেন, নিয়োগ, পদায়ন বা কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক ধরে রাখার ব্যাপারে সরকারি নীতির পরিবর্তন বা উন্নয়ন দরকার। সরকারি নীতিই অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পেশাগত উন্নয়নের বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা চার ধরনের সমস্যার কথা গবেষকদের বলেছেন—চাকরির সুযোগ–সুবিধায় ক্যাডারদের মধ্যে অন্যায্যতা রয়েছে, অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগানো যায় না, বদলির ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায় এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের সুযোগের ঘাটতি আছে।

করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যাগুলো পুরোনো, বহুল আলোচিত। কিন্তু সুরাহার জন্য আন্তরিক উদ্যোগ কেউ কখনো নেননি। সব সময় চিকিৎসকের দোষই ধরা হয়। কিছু সমস্যা দূর করতে স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে। আবার চিকিৎসকেরা মনে করেন, সরকার সব সমাধান করে দেবে, তাঁরা ভাবেন না যে তাঁরাও সরকারের অংশ। তাঁরাও কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারেন। আমরা দেখেছি, ৭৫ শতাংশ সমস্যা চিকিৎসকের উদ্যোগেই সমাধান সম্ভব।’