সোনালি দিনের সুরের ভুবন

কলের গান ‘সেকাল-একাল’ প্রদর্শনীতে দুর্লভ রেকর্ড দেখছেন (বাঁ থেকে) শামীম আমিনুর রহমান, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী ও প্রাবন্ধিক মফিদুল হক। জাতীয় জাদুঘরে, ঢাকা, ২৭ এপ্রিলছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ফেলে আসা দিনের কথা মানুষের স্মৃতিতে বারবার ঘুরেফিরে আসে। বিশেষ করে বয়স যত বাড়তে থাকে, স্মৃতিকাতরতাও তত প্রবল হয়। কিন্তু অতীতে ফিরে যাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না। ফলে হারানো দিনের পরশ লাগা উপকরণগুলোই তখন স্মৃতির দরজা মেলে দেয়।

জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে প্রবেশ করলে দর্শকদের এখন তেমনি এক অনুভূতি হবে। মনে হবে যেন অতীত এক মায়াবী দরজা মেলে দিয়েছে। তার ভেতর দিয়ে সুরের ইন্দ্রজাল যেন নিয়ে যাবে স্বর্ণময় বিগত দিনে। কী নেই সেখানে? আছেন ‘সংগীতসম্রাজ্ঞী’ গওহর জান থেকে শুরু করে বড় মালকা জান, বেগম আখতার, ইন্দুবালা, কানন বালা হয়ে রবীন্দ্র-নজরুল-আব্বাসউদ্দীনসহ সংগীতের কিংবদন্তি সবাই।

এই অতীতের সংগীতসম্ভার আর শ্রোতার কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমের যে ক্রমবিবর্তন ঘটেছে, গত প্রায় দেড় শ বছরে, সেই যাত্রাপথের নিদর্শন নিয়ে শুরু হয়েছে ‘কলের গান, সেকাল-একাল’ নামের এক অনবদ্য প্রদর্শনী। ব্যক্তিগত সংগ্রহের এই প্রদর্শনী এককথায় অতিথিদের ‘অবাক করে দিয়েছে’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সে কথাই বলছিলেন অতিথিরা। স্থপতি, লেখক ও জাদুঘর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য শামীম আমিনুর রহমানের ব্যক্তিগত সংগ্রহের এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান। জাতীয় জাদুঘর এবং সংগ্রাহক যৌথভাবে এই প্রদর্শনীর আয়োজক। প্রদর্শনী চলবে আগামী ১২ মে পর্যন্ত। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৫টা এবং শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা, বন্ধ থাকবে বৃহস্পতিবার।

গান ছিল মানুষের কণ্ঠে। মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৭ সালে শব্দধারণ করার যন্ত্র আবিষ্কার করে যন্ত্রটির নাম দিয়েছিলেন ‘ফোনোগ্রাফ’। পরে জার্মান বিজ্ঞানী এমিল বার্লিনার ১৮৮৭ সালে যন্ত্রটিকে আরও উন্নত করে যন্ত্রটির নাম দেন গ্রামোফোন। এডিসনের ফোনোগ্রাফে শব্দ ধারণ করা হতো ধাতব চোঙের ওপর। আর গ্রামোফোনে শব্দ ধারণ করা হলো চাকতির ওপর। এই চাকতিতে ধারণ করা গান ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিল্পীর কণ্ঠের গান গ্রামোফোন রেকর্ড হয়ে পৌঁছে যায় সাধারণ শ্রোতার ঘরে ঘরে। এর আগে পর্যন্ত উচ্চমার্গের সংগীত সাধারণত রাজা–বাদশাহ–জমিদার প্রভৃতি উচ্চশ্রেণির মানুষের জলসাঘরেই পরিবেশন করতেন শিল্পীরা। সেখানে সাধারণের প্রবেশগম্যতা ছিল না। শোনার সুযোগও তাঁদের ছিল না।

কলকাতায় গ্রামোফোনে প্রথম রেকর্ড হয়েছিল গওহর জানের গান, ১৯০২ সালে। তারপর থেকে যাত্রা শুরু সুরের সাম্পানের। কুকুরের ছাপ্পা দেওয়া হিজ মাস্টার্স ভয়েস বা এইচএমভির গান পরিচিত হয়ে ওঠে ‘কলের গান’ নামে। ব্রিটিশ এইচএমভি ছাড়াও সে সময় মার্কিন ‘কলম্বিয়া’ ও ফ্রান্সের ‘পঠে’ কোম্পানির রেকর্ডও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

ঢাকাতেও ‘ঢাকা রেকর্ড’ নামে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সালাউদ্দিন। ইন্দিরা রোডে ছিল ঢাকা রেকর্ডের কারখানা। এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ বহু বিখ্যাত শিল্পীর গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। এসব বিস্তারিত তথ্য, গানের রেকর্ড আর আদি যুগের গ্রামোফোন থেকে সংগীতযন্ত্রের বিবর্তনের নমুনা আছে এই প্রদর্শনীতে।

দর্শকেরা প্রদর্শনীতে দেখবেন ১৯২৭ সালের ‘কেবিনেট গ্রামোফোন’, চোঙ লাগানো ‘মোনার্ক হর্ন গ্রামোফোন’, ‘পোর্টেবল গ্রামোফোন’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি। স্প্রিংযুক্ত গ্রামোফোনের জায়গায় এসেছে চেঞ্জার, তারপর ফিতাযুক্ত স্পুল প্লেয়ার, তারপর অডিও ক্যাসেট, কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সিডির পরে এখন চলছে স্পটিফাই, ইউটিউব মিউজিকের মতো স্ট্রিমিংয়ের রমরমা।

বিবর্তন এসেছে বেতারযন্ত্রেও। সেই বিবর্তনের নমুনাও সংগ্রহ করেছেন শামীম আমিনুর রহমান। ঢাউস আকারের রেডিও গ্রাম থেকে বাল্ব রেডিও, ট্রানজিস্টর রেডিও, আছে হরেক রকমের টেলিভিশন। এর কোনোটিই কিন্তু অচল নয়, সব যন্ত্রই কার্যকর অবস্থায় রয়েছে। প্রদর্শনকক্ষের মেঝেতে এসব যন্ত্রপাতি আর বহু দুর্লভ লংপ্লে রেকর্ডগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া দেয়ালজুড়ে বড় বড় সচিত্র বোর্ডে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন শিল্পীর ছবি, তাঁদের পরিচিতি, লং প্লে রেকর্ডের ছবি, গ্রামোফোনের বিবর্তনের দৃশ্য, বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রাকালে রেকর্ডের দৃশ্য ও বেতার ভবন। আর আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা দেওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানের রেকর্ড, চরমপত্রের রেকর্ড, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। জর্জ হ্যারিসন-পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেই বিখ্যাত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এর রেকর্ড, তার ইতিহাস, জোয়ান বায়েজ ও ইলিয়ান ওয়েডিংয়ের গানের রেকর্ড।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সে কারণেই প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান বলছিলেন, এই প্রদর্শনী বিস্ময়কর। সংগীতের বিবর্তন উঠে এসেছে এতে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী রফিকুন নবী তাঁর নিজেরও রেকর্ড সংগ্রহের স্মৃতিচারণা করে বললেন, তিনি এই প্রদর্শনী দেখে অভিভূত। মনে হয়েছে যেন অনেকগুলো যুগের মধ্য দিয়ে হেঁটে এলেন।

আরেক বিশেষ অতিথি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বললেন, ‘সংগীতের মধ্য দিয়ে আমাদের সৃজনশীলতা, স্বাধীন জাতিগঠনের আকাঙ্ক্ষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মিলিয়ে এই প্রদর্শনী জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেই দর্শকদের নিবিড়ভাবে চিনিয়ে দেবে।’

জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই এলিজা বিনতে এলাহীর প্রযোজনায় শামীম আমিনুর রহমানের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও তাঁর জীবন নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন শামীম আমিনুর রহমান।

কলের গানের এই প্রদর্শনী দর্শকদের সামনে যেন খুলে দেবে এক স্বর্ণময় ঝাঁপি। অতীতকে বর্তমানে মিলিয়ে দেওয়া সুরের আবেশ ভরিয়ে দেবে অন্তর।