নির্যাতন রোধে চাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) গীতাঞ্জলি সিং, ফারাহ কবির, তানিয়া হক ও নিশাত রহমান। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে। নির্যাতনের ধরন অনুযায়ী আইনের কার্যকর প্রয়োগ, বাল্যবিবাহ রোধ, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ নির্যাতন প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। গতকাল শনিবার রাজধানীতে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা। এ আয়োজনে প্রচার-সহযোগী ছিল প্রথম আলো।

গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ে। ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শিরোনামের বৈঠকে নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়।

বৈঠকের সঞ্চালনায় ছিলেন একশনএইড বাংলাদেশের এ দেশে নিযুক্ত পরিচালক (কান্ট্রি ডিরেক্টর) ফারাহ্ কবির। তিনি বলেন, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে হবে। নারী নির্যাতন শুধু নারীর বিষয় নয়, এটা সমাজের বিষয়। প্রত্যেককে যার যার পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কাজ করতে হবে। মেয়েদেরও নিজের প্রতি আস্থা রাখতে হবে, নিজের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে।

বৈঠকে দেশের লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন পরিস্থিতি ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন একশনএইড বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক (নীতি গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি) তামাজের আহমেদ এবং সংস্থার ব্যবস্থাপক (নারী অধিকার ও লিঙ্গভিত্তিক সমতা) মরিয়ম নেছা। তাঁরা জানান, ২০১৮ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ৬৬ শতাংশই পারিবারিক সহিংসতা। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ ঘটনায় আইনি প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী অনলাইনে নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য তানিয়া হক বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ও করণীয় নির্ধারণে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পুরুষতন্ত্র শুধু নারীকে নয়, পুরুষকেও কীভাবে শারীরিক ও মানসিক চাপে ফেলে এবং নারী নির্যাতনের কারণে পুরুষকেও কীভাবে ব্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়, সেটা তুলে ধরতে হবে।

ইউএন উইমেনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিং বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে তাঁর মনে হয়েছে, এখানে নারী নির্যাতন বন্ধে নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব পরিবর্তন করা প্রয়োজন। যথাযথ তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, যাতে কোন ধরনের সহিংসতা বেশি হচ্ছে, তা জানা যায় এবং সে অনুযায়ী প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া যায়। আইন ঠিকভাবে সুরক্ষা দিচ্ছে কি না, সেটাও পর্যবেক্ষণ করা উচিত।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশনের (সাইবার ও বিশেষ অপরাধ বিভাগ-দক্ষিণ) অতিরিক্ত উপকমিশনার নিশাত রহমান মাঠপর্যায়ে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনলাইনে সহিংসতা এড়াতে মেয়েদের একটু বেশি সচেতন হতে হবে। অনেক মেয়ে স্বামী ও প্রেমিককে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয়। ঘনিষ্ঠ ছবি দেয়। সম্পর্কের অবনতি হলে এই ছবিগুলো ওই ব্যক্তিরা নারীটির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) নূরুন নাহার বেগম বলেন, পরিবার ও সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন শূন্য রাখার ঘোষণা থাকতে হবে ও তা পালন করতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও যৌন-প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, আইনে পারিবারিক নির্যাতনকে এখনো অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষার আইনটি একধরনের নাগরিক প্রতিকার দেয়। ফলে অনেক সময় আইনজীবীরা পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় যৌতুকের মামলা দেন। অনেক সময় তা প্রমাণও করা যায় না। এভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা অনেক মামলা মিথ্যা বলে অপবাদে পড়ে। যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে আইন প্রণয়নে বাধা দূর, আইন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

অভিনয়শিল্পী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, নারীবিদ্বেষী বিষয়বস্তুকে পুঁজি করে অনেক সময় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়ে থাকে, যা একটি ভয়াবহ প্রবণতা। এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা না করার জন্য গণমাধ্যমের সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি।

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের ফাস্ট বোলার জাহানারা আলম বলেন, খেলাধুলা তাঁর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। তিনি প্রতিবাদ করতে শিখেছেন। নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই সবাই মিলে সোচ্চার হওয়া উচিত।

ইউনিলিভারের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, কোভিডের সময় বিশ্বজুড়ে পারিবারিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের কর্মীদের সহায়তার জন্য ২০২০ সাল থেকে ইউনিলিভার একটি নীতি অনুসরণ করছে। ওই নীতি অনুসারে, কোনো কর্মী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে তিনি বাড়ির বাইরে থাকা, আইনি লড়াই ও মনোসামাজিক সহায়তাসহ ৯০ দিনের সহযোগিতা পাবেন।

প্রথম আলোর ইংরেজি ওয়েবের প্রধান আয়েশা কবির গণমাধ্যমের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন, নারীর বিষয়গুলো গণমাধ্যমে বিস্তারিত ও বড় পরিসরে প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেসি কর্মকর্তা আয়শা আখতার কিছু অগ্রগতি তুলে ধরে বলেন, সাক্ষ্য আইনে আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তার চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না—এমন বিধান যোগ করা হয়েছে।

মেয়ে নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তৃষিয়া নাশতারান বলেন, মামলা করতে গিয়ে নারীরা যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে নজরদারি বাড়ানো উচিত।

একশনএইড বাংলাদেশের গার্লস লিড অ্যাকশন প্রজেক্টের প্রতিনিধি পূর্ণিমা ইসলাম বলে, সে নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করার সময় তাকে প্রায়ই বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়। তবে দমে না গিয়ে কাজ অব্যাহত রাখছে।