আঞ্চলিক পিঠার সন্ধানে

২৯ ডিসেম্বর শুক্রবার পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্র আয়োজন করেছিল শীতের পিঠা উৎসবের, তাদের ফরাশগঞ্জের ডেরার ছাদবাগানে। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে যে কটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে, ঢাকা কেন্দ্র তাদের একটি। ফরাশগঞ্জ মহল্লার এককালের সরদার প্রয়াত মওলা বখশের পুত্র মোহাম্মদ আজিম বখশ এই ঢাকা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।

অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক, কবি, লেখক, সংস্কৃতিকর্মীসহ দেড় শতাধিক মানুষ। উৎসবে পরিবেশিত পিঠার মধ্যে ছিল পাটিসাপটা, চিতই, ভাপা, পোয়া, নকশি, হাতকুলি, পাতা, লিচু, ফুল, আথর, ডিম সুজি, মুগপাকন ও ডাল-মসুর পিঠা। ঢাকা কেন্দ্রের একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, এর মধ্যে ঢাকা বা বিক্রমপুরের আঞ্চলিক পিঠা কোনটি। তিনি জানালেন, এভাবে আলাদা করে ভাবা হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে বাংলা অঞ্চলে শীতের পিঠার অভাব নেই। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লেখাপত্র বিশ্লেষণ করে এবং লোকসংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ দেশে ১৫০ বা এরও বেশি রকমের পিঠা রয়েছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। এর মধ্যে মোটামুটি প্রায় ৩০ প্রকারের পিঠার প্রচলন বেশি। আবার একই পিঠার নাম একেক অঞ্চলে একেক রকম। এ ক্ষেত্রে উপাদান ও বানানোর রীতিতে রকমফের থাকতে পারে, আবার না-ও পারে। যেমন ভাপা পিঠাকে কোথাও ধুপি পিঠা বা ধুকি পিঠা বলা হয়। বাষ্পে সেদ্ধ করা হয় বলে এই পিঠার নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়া দিয়ে করা ছোট ছোট পিঠার মাঝে খেজুরের নতুন গুড় আর নারকেল থাকে। গুড়ের জন্য বিখ্যাত যশোর কিংবা নারকেলের জন্য পরিচিত খুলনা, বরিশালসহ সব অঞ্চলেই ভাপা পিঠা জনপ্রিয়।

বাংলাদেশ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বড় উদাহরণ নকশি পিঠা। চালের খামি বানিয়ে মোটা মোটা করে বেলে তার ওপরে খেজুরকাঁটা দিয়ে একটু গভীর করে আলপনা আঁকা হয়। এগুলোকে বলে ফুল নকশি পিঠা, পাকান পিঠা বা সুইকাঁটা দিয়ে নকশা করা মুগপাকন পিঠা। বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে এ পিঠা বেশি তৈরি করা হয়। নকশি পিঠা তৈরির সময় গ্রামীণ নারীরা গেয়ে ওঠেন, ‘কন্যার মা রসিয়া, পাককোয়ান বানায় বসিয়া, এই না পাককোয়ান যাইব, নবীন বিয়াইয়ের দেশে রে।’

ঢাকা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আজিম বখশ ঢাকার তিনটি আঞ্চলিক পিঠার নাম বললেন। তা হলো ভেজা পিঠা, চই পিঠা ও খাতকা বড়া। এর মধ্যে বিশেষ পাতিলে ভেজা পিঠা বিয়ের পরদিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো ঢাকাবাসীর রেওয়াজ। যদিও আজকাল এ রেওয়াজ প্রায় উঠে গেছে।

ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে আরও আছে গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছানার মালপোয়া, বিবিখানা পিঠা, কলাপিঠা, মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, তিল পুলি, সাবুর পিঠা।

নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে রয়েছে ডিমের পানতোয়া, খোলাজা পিঠা, নারকেল পুলি পিঠা, নারকেলের চিড়া। প্রচলিত আছে, খোলাজা পিঠা এক বসায় ১৫টির কম খাওয়া নাকি অসম্মানের!

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠা হলো আতিক্কা পিঠা, বিন্নি পুলি পিঠা। সিলেটের গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠার মধ্যে অন্যতম হলো চুঙ্গাপুড়া পিঠা, নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। চুঙ্গা পিঠা তৈরির জন্য লাগে ঢলু বাঁশ। এখন এই বাঁশ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় চুঙ্গা পিঠা খাওয়াও কমে এসেছে। ময়মনসিংহে কলসি পিঠা নামে একধরনের আঞ্চলিক পিঠার প্রচলন রয়েছে।

বাগেরহাট-খুলনা অঞ্চলের আঞ্চলিক পিঠার নাম বললে শুরুতে আসবে সেমাই পিঠা। একটা সময় কাঠের কাঠামোয় তৈরি কল চেপে এই পিঠা তৈরি করা হতো। এখন কাঠের কলের বদলে ইস্পাতের কল এসেছে। হাতল ঘোরালেই মুখ দিয়ে চিকন সেমাই পিঠা বের হয়। এরপর এই সেমাই ভাপে সেদ্ধ করতে হয়। নতুন আলু আর দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে করা হয় গরম-গরম পরিবেশন। এ ছাড়া চুই-মাংস দিয়েও পিঠাটি খাওয়া হয়। শীতকালে বাড়িতে বড় কুটুম এলেই সাধারণত এই পিঠা তৈরি করা হয়ে থাকে।

আরও কিছু আঞ্চলিক পিঠার নাম বলে যাই। ছাঁচ পিঠা, দোল পিঠা, চাপড়ি পিঠা, মুঠি পিঠা, ছিট পিঠা, সরভাজা পিঠা, মালপোয়া পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝিলমিল পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, মালাই পিঠা, চুটকি পিঠা, গোকুল পিঠা, আন্দশা পিঠা, রসফুল পিঠা, গোকুল পিঠা, ঝিনুক পিঠা, কুশলি পিঠা, নারকেল নাড়ু পিঠা এবং কাউনের মোয়া পিঠা।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক পিঠাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া খুবই দরকার। কারণ, পিঠা কেবল একটি খাবার নয়, স্মৃতির ভান্ডার ও ঐতিহ্যের পরম্পরাও বটে। ঢাকা কেন্দ্রের আজিম বখশ তাই বললেন, আগামী বছর তাঁরা যে পিঠা উৎসব করবেন, তাতে ঢাকা ও বিক্রমপুরের পিঠাকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তেমনিভাবে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশালে শীতকালে যে পিঠা উৎসব হয়ে থাকে, আয়োজকেরা তাতে আঞ্চলিক পিঠাকে প্রাধান্য দেবেন, এমন প্রত্যাশা রইল।