অসহায় মানুষকে ছড়ি দিয়ে সহায়তা করেন তিনি

আবদুল লতিফ মণ্ডল
ছবি: মোশতাক আহমেদ

তিন দশক আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান আবদুল লতিফ মণ্ডল। একবার নামাজ পড়তে গিয়ে আর বসতে পারছিলেন না। এর পর থেকে ছড়ি (লাঠি) হয় তাঁর নিত্যসঙ্গী। তখনই উপলব্ধি করেন, অসহায় মানুষের কাছে এ ছড়ির মূল্য কত। সেই উপলব্ধি থেকে অসহায় মানুষকে বিনা মূল্যে লাঠি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক বিভাগীয় পরিদর্শক আবদুল লতিফ মণ্ডলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। তবে থাকেন ঢাকার উত্তরা আজমপুর রেলগেট–সংলগ্ন এলাকার বাসায়। তাঁর এক আত্মীয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তার মাধ্যমেই জানা গেল আবদুল লতিফ মণ্ডলের ব্যক্তিগত এই উদ্যোগের কথা।

৮০ বছরের বেশি বয়সী আবদুল লতিফের সঙ্গে ২৬ সেপ্টেম্বর কথা হয় তাঁর বাসায় বসে। এ সময় তিনি জানান, ১৯৯২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান। ২০০৭ সালে নামাজ পড়তে গিয়ে বসতে পারছিলেন না। তখন টঙ্গী থেকে ৭০০ টাকা দিয়ে একটি ছড়ি কেনেন। এরপর এ ছড়িই হয় তাঁর সঙ্গী। ২০১০ সালে হজে যান এই ছড়ি নিয়েই। সঙ্গে ছিল হুইলচেয়ার।

এভাবে ছড়িকে সঙ্গী করেই চলছিল আবদুল লতিফের জীবন। এরপর ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান মেয়ের কাছে। দুই মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সেখানে বসেই সিদ্ধান্ত নেন অসহায় মানুষকে লাঠি দিয়ে সহায়তা করার। তখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি দোকানে গিয়ে লাঠির দাম জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, একটির দাম বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ১০০ টাকা। তবে সেখান থেকে ছড়ি কেনেননি।

এরপর ছোট মেয়ে রেবেকা সুলতানা ইসলামসহ দেশে ফেরেন আবদুল লতিফ। ঢাকায় ফেরার পর একপর্যায়ে তাঁর ছোট মেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশের একটি মেডিকেলের দোকান থেকে ১০টি ছড়ি কিনে দেন তাঁকে। দাম পড়ে ৩৫০ টাকা করে। সেগুলো তিনি অসহায় মানুষদের দেন।

আবদুল লতিফ বলেন, ‘আমি বাসার নিচে বসি এবং মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় অনেক গরিব মানুষকে বাঁশের লাঠি বা কাঠের লাঠি নিয়ে আসতে দেখতাম। তখন মেয়ের কিনে দেওয়া ওই ১০টি লাঠি তাঁদের দিই।’

সেই থেকে মানুষকে ছড়ি দিয়ে যাচ্ছেন আবদুল লতিফ। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত কতগুলো লাঠি দিয়েছেন, তা গুনে রাখেননি। তবে এ সংখ্যা ২৫০ থেকে ৩০০টি হবে।

আবদুল লতিফ জানান, প্রথমে মেয়ে ১০টি ছড়ি কিনে দিলেও এরপর তিনি নিজেই জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীত পাশের সেই দোকানে গিয়ে ছড়ি কিনে আনতেন। বাস, রিকশা ইত্যাদি যানবাহনে করে ছড়ি কিনতে যেতেন। তখন দোকানি ৩০০ টাকায় ছড়ি দিতেন। একপর্যায়ে দোকানি বলেন, কষ্ট করে তাঁকে আর দোকানে আসতে হবে না। যখন প্রয়োজন হবে, তখন জানালে বাসায় ছড়ি পাঠিয়ে দেবেন। সে জন্য অবশ্য ৫০ টাকা করে বেশি দাম দিতে হতো।

আবদুল লতিফ মণ্ডল
ছবি: মোশতাক আহমেদ

একপর্যায়ে টঙ্গীতে যান ছড়ি কিনতে। টঙ্গীর দোকানটি তাঁর আজমপুর রেলগেট–সংলগ্ন বাসা থেকে তুলনামূলক কাছে। এখন টঙ্গীর ওই দোকান থেকে ২৫০ টাকা করে ছড়ি কিনে বিনা মূল্যে বিতরণ করেন।

আলাপের ফাঁকে বাসায় রাখা কয়েকটি ছড়ি দেখিয়ে লতিফ মণ্ডল বলেন, বিতরণ করার পর এখন এই কটি অবশিষ্ট আছে। জানালেন, কোথাও গেলে গাড়িতে পাঁচটি ছড়ি নিয়ে যান এবং রাস্তায় এমন কাউকে পেলে দিয়ে দেন।

কোথায় কোথায় যান, জানতে চাইলে লতিফ মণ্ডল বলেন, ময়মনসিংহে যান, গ্রামের বাড়ি গফরগাঁওয়েও যান। তবে তাঁর কাছে যে কেউ লাঠি চাইলেই দেন।

আবদুল লতিফের দুই মেয়ে, দুই ছেলে। দুই মেয়েই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তবে একজন দেশে ময়মনসিংহে ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই জায়গাতেই থাকেন। আর দুই ছেলের একজন থাকেন ময়মনসিংহে, আরেকজন ঢাকার বাসায় একটি ফ্ল্যাটে। সেই বাসায় তিনি থাকেন আরেক ফ্ল্যাটে। স্ত্রী মারা গেছেন ২০০৯ সালে। তিনি জানান, এখন আর নিজের নামে কোনো সম্পত্তি নেই। সব সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাই না, মারা যাওয়ার পর আমার সহায়-সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি হোক।’
আবদুল লতিফের বাসায় যাওয়ার সময় নিচেই এক বয়স্ক নারীকে দেখা গেল। আনোয়ারা বেগম নামের ওই নারী জানান, তাঁর হাতে থাকা লাঠিটি লতিফ মণ্ডলের দেওয়া।

লতিফ মণ্ডলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর ব্যক্তিগত এ উদ্যোগের কোনো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বা ধারাবাহিকতা চান কি না। জবাবে বললেন, ‘অক্টোবর-নভেম্বরে আমার ছোট মেয়ে দেশে আসবে। তখন তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব, আমি না থাকলেও কীভাবে এটি (চলতে) থাকে।’