সাক্ষীকে আমার সামনে বকবেন না, প্রসিকিউটরকে ট্রাইব্যুনাল

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালফাইল ছবি

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনা সাক্ষীকে গালিগালাজ না করার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘দয়া করে সাক্ষীকে এখানে গালিগালাজ করবেন না। সাক্ষীকে আমার সামনে বকবেন, এটা চলবে না।’

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের পরিদর্শক মো. রুকুনুজ্জামানের জবানবন্দি গ্রহণের সময় মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল এ কথা বলেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল–১–এর বিচারক মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী দায়িত্ব পালন করছিলেন।

সিআইডির পরিদর্শক রুকুনুজ্জামান জবানবন্দি দেওয়ার পর তাঁকে জেরা করছিলেন এ মামলার পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। জেরার এক পর্যায়ে রুকুনুজ্জামানের উদ্দেশে ‘আপনার মাথা খারাপ’ বলে মন্তব্য করেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘সাক্ষীকে ধমকাইয়েন না।’ সঙ্গে সঙ্গে মিজানুল ইসলাম ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

রুকুনুজ্জামানের জেরা সম্পন্ন হলে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে গালিগালাজ না করার নির্দেশনা দিয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সাক্ষীকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে আনবেন।

‘বিচারের আন্তর্জাতিক মান রাখতে হবে’

সিআইডির ঢাকা ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহেদ জোবায়ের এ মামলায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে শাহেদ জোবায়ের বলেন, গত ১২ মে এ মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা আলামত হিসেবে একটি সিডি ও একটি ডিভিডি দেন। সিডিতে শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের তর্কিত কথোপকথন সংরক্ষিত ছিল। আর ডিভিডিতে তাঁদের উভয়ের প্রামাণ্য কণ্ঠস্বর সংরক্ষিত ছিল। যাচাই করে নারী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে শেখ হাসিনার নমুনা কণ্ঠস্বরের মিল পাওয়া যায় এবং পুরুষ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মাকসুদ কামালের নমুনা কণ্ঠস্বরের মিল পাওয়া যায়।

জবানবন্দি দেওয়ার পর শাহেদ জোবায়েরকে জেরা করেন এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন। জেরায় শাহেদ জোবায়ের বলেন, ‘একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের কণ্ঠস্বরের মিল থাকতে পারে।’ তারপর আমির হোসেনের জেরার জবাবে শাহেদ জোবায়েরের আরও উত্তর লিপিবদ্ধ হয়।

একজনের সঙ্গে আরেকজনের কণ্ঠস্বরের মিল থাকতে পারে—এ কথার সঙ্গে আরও কিছু কথা যোগ করতে চান বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করেন সাক্ষী শাহেদ জোবায়ের। এর বিরোধিতা করে আমির হোসেন বলেন, এ প্রসঙ্গ আগেই চলে গেছে। ট্রাইব্যুনালও বলেন, জবাব তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে।

তখন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, সাক্ষী শাহেদ জোবায়েরকে সুযোগ দেওয়া উচিত। এ সময় প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ারের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, বিচারের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে, এটা মনে রাখতে হবে।

পরে প্রসিকিউশন সাক্ষী শাহেদ জোবায়ের পুনঃ জবানবন্দির আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। পুনঃ জবানবন্দিতে শাহেদ জোবায়ের বলেন, কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যারে এলআর রেশিও (লাইকলিহুড রেশিও) সাধারণত ১–এর ওপরে হলে বিতর্কিত কণ্ঠস্বর ও নমুনা কণ্ঠস্বর এক ও অভিন্ন বলে ধরে নেওয়া হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনার নমুনা কণ্ঠস্বর ও বিতর্কিত কণ্ঠস্বরের এলআর রেশিও ছিল ২–এর ওপরে। এ কারণে বিতর্কিত কণ্ঠস্বরটি শেখ হাসিনার বলে মতামত প্রদান করেন।

শেখ হাসিনার আইনজীবীর প্রশংসায় ট্রাইব্যুনাল

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের বিরুদ্ধে এ মামলায় মঙ্গলবার প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইন। এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার, সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

জাকির হোসাইন জবানবন্দিতে বলেন, ২৪ মার্চ তাঁর খাসকামরায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার আগে সাবেক আইজিপি মামুনকে চিন্তাভাবনা করার ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সময় দেন তিনি।

জাকির হোসাইনের জবানবন্দি শেষে জেরার সময় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, জাকির হোসাইন জবানবন্দি গ্রহণের আগে সাবেক আইজিপি মামুনকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পরিণতি বুঝিয়ে বলেননি এবং তা তাঁর (জাকির হোসাইন) জবানবন্দিতেও লিখিত নেই।

এই বক্তব্য গ্রহণ করা হবে কি না, তা নিয়ে ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও আমির হোসেনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্ক হয়। আমির হোসেনের এই প্রশ্ন ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করেননি। একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই প্রশ্ন আর করতে দেওয়া হবে না।

সাক্ষী জাকির হোসাইনের জেরা শেষ হলে আমির হোসেনের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আপনার (আমির হোসেন) কাজ ফাইট (আইনি লড়াই) করা। ইউ আর ফাইটিং ওয়েল (আপনি ভালো লড়েছেন)।’

সময় চেয়েও পেলেন না আসামিপক্ষের আইনজীবী

শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা এই মামলায় মঙ্গলবার ছয় সাক্ষী জবানবন্দি প্রদান করেন। তাঁরা হলেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন, পুলিশের এসআই মো. গোলাম ইফতেখার আলম, সিআইডির ব্যালিস্টিক শাখার বিশারদ শেখ নজরুল ইসলাম, সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের পরিদর্শক মো. রুকুনুজ্জামান ও সিআইডির এসআই মো. শাহেদ জোবায়ের। এ নিয়ে এই মামলায় মোট ৪৫ জন সাক্ষী জবানবন্দি দিলেন।

জাকির হোসাইন, সিরাজুস সালেহীন, গোলাম ইফতেখার ও শেখ নজরুল ইসলামের পর রুকুনুজ্জামান জবানবন্দি দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ডিভিডি, হার্ডড্রাইভের মতো বিষয়গুলো তিনি বোঝেন না। বিষয়গুলো তাঁর বোঝা দরকার। তা ছাড়া এসব জেরা করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা দরকার। এসব কারণে তাঁর সময় প্রয়োজন।

তবে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি জানায় প্রসিকিউশন। একপর্যায়ে সময় না দিয়ে আমির হোসেনকে জেরা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল এই ছয় সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।