জেলার রাজনীতি—৪
দিনাজপুরে সংগঠিত বিএনপি, বিভক্ত আওয়ামী লীগ
মিছিল–মিটিং ও সরকারবিরোধী আন্দোলন–সংগ্রামে ব্যস্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা। আর আওয়ামী লীগ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পৃথক কর্মসূচি পালন করে।
একসময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দিনাজপুর জেলায় ঝিমিয়ে পড়া নেতা-কর্মীরা আবার চাঙা হয়ে উঠেছেন। বছরখানেক আগে জেলা বিএনপির সম্মেলনের পর গঠিত কমিটির নেতা-কর্মীরা আন্দোলন, মিছিল-মিটিং করে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছেন।
জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের সব কটি আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও দিনাজপুরে দৃশ্যমান তেমন কোনো উন্নয়ন নেই। জেলা আওয়ামী লীগ বাদে ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনগুলোরও নেই হালনাগাদ কোনো কমিটি। এই সুযোগে জেলা কমিটিতে তৈরি হয়েছে দুটি পক্ষ। যদিও নেতা-কর্মীরা বলছেন, এটি বিভক্তি নয়; বরং নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা।
বিএনপির লক্ষ্য এক দফা
বিএনপির স্থানীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাবার বাড়ি দিনাজপুরে হওয়ায় এ জেলা বিশেষ করে সদর উপজেলা বিএনপির ঘাঁটি—এমন কথা প্রচলিত আছে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে দিনাজপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশীদ জাহান হক।
২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর দলের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। নির্ভরযোগ্য প্রার্থী না থাকায় ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) শফিউল আলম প্রধান। সেবার নির্বাচনে বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের কাছে হেরে যান তিনি। এরপর ২০১০ সালে জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান যথাক্রমে লুৎফর রহমান ও মুকুর চৌধুরী। ২০১৬ সালে অসুস্থতার কারণে মুকুর চৌধুরীর ও ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে লুৎফর রহমানের মৃত্যু হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বে অচলাবস্থা এবং বর্তমান সরকারের বিগত ১৫ বছরে প্রায় নাজুক অবস্থায় ছিল জেলা বিএনপি। হামলা-মামলার শিকার হয়ে দলের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীর বড় সময় কাটছে আদালতের বারান্দায়। এমন অচলাবস্থায় গত বছরের মে মাসে দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান যথাক্রমে মোফাজ্জল হোসেন ও বখতিয়ার আহমেদ। এরপর থেকে দৃশ্যত নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, জেলা বিএনপির ২২টি ইউনিটের ২০টিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলায় স্থানীয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে (হাফিজ সরকার ও আখতারুজ্জামান মিয়া) কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি হয়েছে। অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও দলীয় নানা কর্মসূচিতে তৎপর রয়েছেন।
আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে সম্প্রতি দিনাজপুরের ছয়টি আসনের তিনটিতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছেন। যদিও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ বলছেন, কে প্রার্থী হবেন, না হবেন সেই চিন্তা তাঁদের মাথায় নেই। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ই এখন তাঁদের মূল লক্ষ্য। দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী, সেই লক্ষ্যেই আন্দোলন–সংগ্রামে মাঠে আছেন তাঁরা।
বখতিয়ার আহমেদ আরও জানান, জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর ১৬০টির বেশি ‘রাজনৈতিক’ মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামি আছেন চার হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। যাঁদের প্রত্যেককে মাসে ছয়-সাতবার আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। তিনি নিজেও ৪৩টি মামলার আসামি বলে জানান বিএনপির এই নেতা।
জেলা আ.লীগে দুটি পক্ষ
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক দশক পর গত বছরের ২৮ নভেম্বর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। সভাপতি হয়েছেন দিনাজপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার আর সাধারণ সম্পাদক হন আলতাফুজ্জামান মিতা। এরও প্রায় এক মাস আগে সদর উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছে। তবে এখনো জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকটি ইউনিটের কমিটি নেই। সেই সঙ্গে দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর এক-তৃতীয়াংশই পরিচালিত হচ্ছে ৪ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে।
দিনাজপুরে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সভাপতি হিসেবে হামিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তারপর কেটে গেছে প্রায় ২৬ বছর। সেই কমিটি দিয়েই চলছে দিনাজপুর জাতীয় শ্রমিক লীগ।
শুধু জাতীয় শ্রমিক লীগই নয়, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়েছিল প্রায় ৫ বছর আগে, যুবলীগের ৪ বছর, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৯ বছর, যুব মহিলা লীগের ১০ বছর, কৃষক লীগের সম্মেলন হয়েছিল ১৮ বছর আগে। দিনাজপুরে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটি ছাড়া সব ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। এতে সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। পাশাপাশি দলে বিভক্তি দেখা দিচ্ছে বলে মনে করেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।
জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সহযোগী সংগঠনগুলো দলের প্রাণশক্তি। দলের ভাবমূর্তি রক্ষা ও নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখতে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগেই সংগঠনগুলোকে গোছাতে তৎপরতা জরুরি।
জেলা আওয়ামী লীগ এখন দৃশ্যমান দুটি পক্ষে বিভক্ত। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে একটির পরিচিতি ‘ফিজার গ্রুপ’, অপরটি ‘ইকবাল গ্রুপ’ নামে। জেলার নেতাদের সঙ্গে নিয়ে একটির নেতৃত্বে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা।
সদর উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে অপর পক্ষটি চলছে জাতীয় সংসদের হুইপ ও দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিমের নেতৃত্বে। বিভিন্ন জাতীয় ও দলীয় কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে পক্ষ দুটির নেতারা পৃথক কর্মসূচি পালন করেন।
জানতে চাইলে ইকবালুর রহিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত দিনাজপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শেখপুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোমিনুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় দল, যোগ্য নেতৃত্বের সংখ্যা বেশি। সুতরাং পদপদবি কিংবা স্বার্থের কারণে গ্রুপিং আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে দলের বৃহৎ স্বার্থে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।’
দলে সমন্বয় না থাকার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো এমপির দল নয়। বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখানে কোনো গ্রুপিং নেই। জেলা কমিটিতে প্রতিটি উপজেলার নেতাদের রাখা হয়েছে।