গণহত্যার স্বীকৃতি ও জবাবদিহি জরুরি

‘পলিটিকস অব জেনোসাইড রিমেম্বারেন্স’ শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতায় এলিসা ভন ফরগে। গতকাল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনেপ্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশনের নির্বাহী পরিচালক এলিসা ভন ফরগে বলেছেন, বিশ্বে গণহত্যা বন্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় গণহত্যার স্বীকৃতি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পাকিস্তান কখনো বাংলাদেশে গণহত্যায় তাদের দায় স্বীকার করেনি। শুধু তা–ই নয়, সে সময়ে পাকিস্তানের সমর্থক ও মিত্ররাও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দায় এড়াতে সক্ষম হয়েছিল।

গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘পলিটিকস অব জেনোসাইড রিমেমবারেন্স’ শীর্ষক এক বিশেষ বক্তৃতায় এলিসা ভন ফরগে এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ গণহত্যা দিবসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ওই বিশেষ বক্তৃতার আয়োজন করে।

বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন এলাকায় আঞ্চলিক বিরোধ ঘিরে কীভাবে গণহত্যায় মদদ দেয়, তা নিজের বক্তব্যে তুলে ধরেন এলিসা। ফিলিস্তিনের গাজার পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি প্রশ্ন করেন, যদি এটি গণহত্যা না হয়, তাহলে কোনটি গণহত্যা। পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল এই গণহত্যা চালাচ্ছে। যেভাবে তারা এটি করেছিল ১৯৭১ সালে, তাদের মিত্র পাকিস্তানের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারত্বের কারণে ইসরায়েলি গণহত্যার কথা অস্বীকার করছে এবং ইসরায়েলকে এই অপরাধ করার অনুমতি দিচ্ছে। ১৯৭১ সালেও (বাংলাদেশে গণহত্যার ক্ষেত্রে) এই ভূরাজনীতি কাজ করেছে।

আর্টসাখে (নগরনো কারাবাখ) আজারবাইজানের গণহত্যার কথা তুলে ধরে এলিসা ভন ফরগে বলেন, আজারবাইজান চার হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে। ওই গণহত্যা সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষ জানে না। কারণ, বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া এর সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই গণহত্যার বিষয়টিকে অবহেলা করেছে।

গণহত্যার মতো অপরাধের বিচারের গুরুত্ব তুলে ধরে এলিসা বলেন, গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার এবং জবাবদিহি না হলে ভবিষ্যতে তাদের আবারও এ ধরনের কাজে জড়ানোর আশঙ্কা তিন গুণ বেশি থাকে।

লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশনের পরিচালক বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি জঘন্য গণহত্যার শিকার হয়েছে। ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। ২ থেকে ৪ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হন। যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছিল, তখন তারা ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বাংলাদেশে যুদ্ধ চলাকালে অনেক সাংবাদিক ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭২ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে ‘অ্যাক্টস অব জেনোসাইড’ সংঘটিত হয়েছে।

৫০ বছর পর লেমকিন ইনস্টিটিউট ও জেনোসাইড ওয়াচ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে জানিয়ে এলিসা ফরগে বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি বিভিন্ন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কেস স্টাডি হিসেবে পড়ানো হয়। কিন্তু এই গণহত্যার বিষয়টি সেভাবে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভূরাজনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ততা এর অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের জন্য জাতীয় সংসদ ২০১৭ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য জাতিসংঘে আবেদন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির জন্য কূটনৈতিকভাবে সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক কারা তা বিশ্ববাসী জানে। তাদের হাতেই কলকাঠি। তবে চেষ্টা অব্যাহত থাকলে স্বীকৃতি পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবির বিষয়টি করুণা ভিক্ষা নয়। গণহত্যা বন্ধ না হলে মানবসভ্যতা বিপর্যস্ত হবে। বিশ্ব বিবেককে এটি অনুধাবন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব সারা যাকের বক্তব্য দেন।