বাংলায় গান গাই

রাহুল আনন্দ

ছোটবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে ছিল শহীদ মিনারের একটা ছবি, পেছনে টুকটুকে লাল সূর্য। এই ছবি এঁকে এঁকেই আমরা বড় হয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে ফুল হাতে যাওয়া আর কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’। তখন পাড়ামহল্লায় ইট-কাদা আর শুকনা ডালপালা দিয়ে শহীদ মিনার গড়তাম আমরা। সেই হাতে গড়া মিনারেও বন্ধুরা মিলে ফুল দিতাম। সে সময় ইতিহাসটা জানতাম না বলে আনন্দটাই মুখ্য ছিল। বড় হতে হতে আমরা ভাষা আন্দোলন, ভাষার জন্য লড়াইয়ের কথা জানতে পারি, রক্তাক্ত রাজপথের কথা জানতে পারি। আমাদের বোধে–মননে একুশে ফেব্রুয়ারির উপলব্ধি বদল হয়। আনন্দের জায়গায় যুক্ত হয় শ্রদ্ধা ও কান্না। কী এক মমতায় মাতৃভাষাকে চিনতে শিখি! আমরা বাংলা মায়ের ছেলে...বাংলায় কথা কই...স্বপ্ন দেখি...গান বাঁধি।

চারুকলায় পড়ার সময় ছাত্র-শিক্ষক মিলে শহীদ মিনারের বেদিতে, সামনের রাস্তায় আলপনা আঁকতাম। ওই আলপনায় আমি আমার মা-দিদিমার উঠানজুড়ে আঁকা আলপনার স্মৃতি যেমন পেতাম, তেমনি খুঁজে পেতাম বর্ণমালাকেও। এ বর্ণমালা রক্তে স্নাত, বড় আদরের আর আমাদের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন।

‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়...’ এসব কথা তো আমরা গানেই বলেছি। আদতে সংগীত নানাভাবে আমাদের সময়কে অনুপ্রাণিত করে, সাহস জোগায়। পৃথিবীর বুকে মাতৃভাষার জন্য আমাদের লড়াইও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আমরা কয়েকটা গানের কথা জানলেও সে সময় বা তার পরবর্তীকালে অসংখ্য গান-কবিতা রচিত হয়েছে এই পটভূমিকায়, বাংলাকে ভালোবেসে। সে গান–কবিতার শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, আলোর দিশা হয়ে।

আজও বাঙালির নানান জাগরণে মুখ্য হয়ে ওঠে গান। অকালপ্রয়াত গীতিকবি রাজীব আশরাফের লেখা ‘হোক কলরব’ এই সময়ের সব আন্দোলনের সবচেয়ে বড় স্লোগান। একই পরম্পরায় আজও আমরা সুখ-অসুখ কিংবা ক্ষোভ-অভিমান-দ্রোহের কথা গীতিকবিতাতেই লিখে যাই, গেয়ে উঠি প্রতিবাদে আর প্রেমে। সে ধারাবাহিকতা ‘আমি কি ভুলিতে পারি?’

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মানুষ নানান ভাষায় কথা কয়; কিন্তু অনেক জাতিকে লিখতে গেলে অন্যের বর্ণমালা ধার করতে হয়। আমরা বাঙালিরা গর্বিত যে নিজস্ব বর্ণমালায় আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলি, লিখি, পড়ি।

এই যে আমি এবং আমরা বাংলায় গান লিখি, গাই অথবা স্বপ্ন দেখি—এ তো একুশের অবদান, অনুপ্রেরণা। একুশের চেতনায় স্নাত হয়ে এবং নিজের পরিচয়কে সামনে রেখে আমরা বহুদূর হাঁটার সংকল্প করি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাই বলতে পারি, এ ভাষায় আমাদের সব চর্চাই ভাষা আন্দোলন থেকে উৎসারিত। আমরা যেন বাংলাকে উদ্‌যাপন করি—এই হোক আমাদের ব্রত। সব ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা। শেষে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা থেকে আবারও বলি, ‘আমি জন্মেছি বাংলায়/ আমি বাংলায় কথা বলি।/ আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।’

রাহুল আনন্দ: সংগীতশিল্পী ও থিয়েটারকর্মী