মধ্যরাতের হরর, কিস মি কুইক, কুকুরচিতা—এমন গাছ চেনাচ্ছেন তিনি

গাছ, ফল–ফুল চেনাতে বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়ান আজহারুল ইসলাম খানছবি: সংগৃহীত

মধ্যরাতের হরর, কিস মি কুইক, কাউবয় লিপস্টিক, বুলেট ট্রি, জংলি বাদাম, সুবাসিত গুলাচি—এমন অসংখ্য গাছ, ফল–ফুল চেনাচ্ছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী মো. আজহারুল ইসলাম খান। তবে এসব উদ্ভিদ চেনানোর কাজটি করছেন ফেসবুকে ছোট ছোট ভিডিওর মাধ্যমে। ফেসবুকে তাঁর অনুসারী সাত লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ২৪ ঘণ্টায় কোনো কোনো ভিডিও দেখা হচ্ছে ১০ লাখের বেশি বার।

সম্প্রতি কথা হলো এই উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি ছোট ছোট ভিডিওতে গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম, গুরুত্ব, ঔষধি গুণ এবং দৈনন্দিন জীবনে কী ভূমিকা রাখছে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তবে ভিডিওতে তিনি উদ্ভিদের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করলেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভেষজ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে তা ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।

ভিডিও করার মাধ্যমে গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম, গুরুত্ব, ঔষধি গুণ এবং দৈনন্দিন জীবনে কী ভূমিকা রাখছে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন এই উদ্ভিদবিজ্ঞানী
ছবি: সংগৃহীত

আজহারুল ইসলাম খান (৫৪) পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে। এরপর দীর্ঘ ২৭ বছর একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তিনি উদ্ভিদ চেনানোর এ কাজ ছাড়াও বর্তমানে একটি ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত আছেন। তিনি থাকেন রাজধানীর মিরপুরে।

গাছ চিনতে হলে এ বিষয়ে পড়াশোনা করতেই হবে, এমনটা মনে করেন না আজহারুল ইসলাম। অবশ্য এ বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন বলে গাছের বৈজ্ঞানিক নাম বা অন্যান্য তথ্য মনে রাখতে পারেন। লোকজন যাতে সহজে একটি গাছ বা উদ্ভিদ চিনতে পারেন, সে জন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

আজহারুল ইসলাম বলেন, ভেষজ ও বিলুপ্তপ্রায় গাছপালার বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দেন তিনি। আর এই গাছ খুঁজতে কোনো দিন জাতীয় উদ্যান, কোনো দিন জিন্দা পার্ক, কোনো দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বা বাড়ির আশপাশে পথের ধারে অবহেলায় জন্ম নেওয়া উদ্ভিদ, তৃণ, গুল্ম যা পান, সেখানেই ছুটে যান। কোনো বিলুপ্তপ্রায় গাছের সন্ধান পেলে ঢাকার বাইরেও ছুটে যান তিনি। তবে বিলুপ্ত বা দুর্লভ গাছের ভিডিও করার ক্ষেত্রে গাছটি কোথায়, তা তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান, যাতে কেউ ওই গাছ তুলে নিয়ে না যান বা ধ্বংস না করেন।

বড় হচ্ছে উদ্ভিদ চেনানোর তালিকা

আজহারুল ইসলাম নিজেকে একজন গাছ ও প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি জানান, মানুষ এখন ব্যস্ত। উদ্ভিদ নিয়ে ভিডিও দেখার জন্য কেউ ৩০ বা ৪০ মিনিট সময় ব্যয় করতে চান না। তবে কেউ যখন দেখে এক মিনিট বা দুই মিনিটের ভিডিও, তখন ভাবেন—‘আচ্ছা দেখাই যাক, এখানে কী বলতে চেয়েছেন’। এ জন্যই তিনি ছোট ছোট ভিডিও বানান।

ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করা প্রসঙ্গে আজহারুল ইসলাম বলেন, আগে তিনি নিজেই গাছের ভিডিও করতেন। তারপর তা দেখা শেষে মুঠোফোন থেকে মুছে ফেলতেন। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করা শুরু করেছেন। তবে এ কাজের জন্য তিনি তাঁর গাড়িচালক সাইদুল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ভিডিও ধারণ করার কাজটা করে দেন তাঁর গাড়িচালকই।

আজহারুল ইসলাম নিজেকে একজন গাছ ও প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে পরিচয় দেন
ছবি: সংগৃহীত

আজহারুল ইসলামের কাজে কখনো বাধা দেন না স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার, পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ে জারিন তাসনিম ও এসএসসি পাস করা ছেলে মাশরাফি বিন আজহার। আর ফেসবুকে ভিডিও শেয়ার করার ক্ষেত্রে আজহারুল ইসলাম তাঁর এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তফিল উদ্দিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তিনি জানান, ফেসবুকে কোনো ভিডিও দেওয়ার পর ওই শিক্ষক তা মনোযোগ দিয়ে দেখেন। এরপর ফোন করে উৎসাহ দেন তাঁকে।

ভিডিওর বাহারি শিরোনাম দেন আজহারুল ইসলাম—‘স্ট্যাম্প সিল তৈরিতে যে উদ্ভিদের কাঁটা ব্যবহার করা হতো’, ‘কডুরা পাতা মাছ পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয়’, ‘নাকের পলিপে কি মহাতিতিঙ্গা কার্যকরী’, ‘গ্রিন টি গাছের কোন অংশ থেকে তৈরি করা হয়’, ‘স্বর্ণ মাপার জন্য রতি গোটা’, ‘উকুন নিরাময়ে কার্যকরী ভেষজ ওষুধ’, ‘অ্যারোমেটিক জুঁই নামে কোনো ফুলের অস্তিত্ব নেই’, ‘পানের সঙ্গে খয়ের নয়’, ‘ওষুধ হিসেবে দেহে সয়’, ‘তালশাঁসের সঙ্গে বরফের সম্পর্ক আছে কি না’...এভাবে নানা অজানা তথ্য নিয়ে ফেসবুকে হাজির হচ্ছেন আজহারুল ইসলাম।

ঔষধি উদ্ভিদ কুকুরচিতা, হাতিশুঁড়, দাদমর্দন, ভূঁইওকড়া, ধুতরা, বহেড়া, অর্জুন, নাগমণি, রামতুলসী, বৈদ্যিরাজ, উদাল, গামারি, বন পেয়ারা, বিষকাটালি, বড় কল্কাসুন্দা, আকন্দ, নারিঙ্গা, ভূঁই–আমলা, মেরাগোটা, কুলঞ্জন, গুলঞ্চ, জগৎমদন, বান্দরহুলা, রামবাসক, কুকসিম...এভাবে বর্ণনা চলছেই। হারিয়ে যাওয়া কাউফল, আগ্রাসী উদ্ভিদ সিঙ্গাপুর ডেইজি, বিষাক্ত কলকে ফুল, টুথব্রাশ প্ল্যান্ট, মিকিমাউস প্ল্যান্ট, আসর বৃক্ষের ফুল, তীব্র সুগন্ধি ফুল, অর্থকরী উদ্ভিদ বেত, শীতলপাটি (মুর্তা বা মুস্তাক), হিজল ফুলের মালা, ভাসমান জলজ উদ্ভিদ চাঁদমালা, বিষাক্ত উদ্ভিদ পার্থেনিয়াম, পাকুড় একটি বৃহদাকার বৃক্ষ, নাগচূড়া বা আমব্রেলা ট্রি, ম্যাজেস্টিক হ্যাভেন লোটাস, শুভ্রমতি ফুল, হেলেঞ্চা শাক, মালঞ্চ শাক, গিমাশাক, বুদ্ধনারিকেল, চমশা মঞ্জরি, হারিয়ে যাওয়া ডাল অড়হর—এভাবে তালিকাটা শুধু বড়ই হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য পরাগায়ন, সপুষ্পক, অপুষ্পক উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য, একবীজপত্রী, দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ চেনার উপায়—সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু ভিডিও করার চেষ্টা করছেন আজহারুল ইসলাম।

ফেসবুকে আজহারুল ইসলামের অনুসারী সাত লাখ ছাড়িয়ে গেছে
ছবি: সংগৃহীত

অকারণে গাছ ধ্বংস নয়

আজহারুল ইসলাম বলেন, অকারণে গাছ ধ্বংস বা কাটা যাবে না। মানুষের প্রয়োজনে গাছ কাটতে হলে সে জায়গায় আরেকটি গাছ রোপণ করতে হবে। বর্ষাকালে দেশি ফলের গাছ রোপণ করতে হবে। কোন জায়গায় কোন গাছ রোপণ করা হচ্ছে, তার ইতিবাচক–নেতিবাচক দিক গাছ লাগানোর আগেই চিন্তা করতে হবে। সড়কদ্বীপে এমন কোনো গাছ রোপণ করা ঠিক হবে না, যা উপড়ে পড়ে মানুষের প্রাণ যায়।

আজহারুল ইসলামের মতে, অসুখ হলে যেমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়, তেমনি গাছ রোপণের আগেও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। আর তাপপ্রবাহের সময় গাছ রোপণের কথা মনে হলে চলবে না, আগে থেকেই পরিকল্পনা করে গাছ রোপণ করতে হবে। বর্ষাকালে গাছ রোপণ করলে তার সুফল পেতে দুই তিন বছর অপেক্ষা করতেই হবে। তার আগেই গাছ কেন ছায়া দিচ্ছে না, তা বলে চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না।

শিক্ষার্থী, বিশেষ করে নবম–দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পরাগায়ন, সপুষ্পক, অপুষ্পক উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য, একবীজপত্রী, দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ চেনার উপায়—এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও করেন আজহারুল ইসলাম। এতে শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদ চেনার পাশাপাশি পড়াও পড়ে ফেলছে। আজহারুল ইসলাম যেসব জায়গায় যান, সেখানে শিশুরা থাকলে তাদের সঙ্গে নিয়েই ভিডিও করেন আজহারুল ইসলাম। বর্ষাকালে শিশুদের গাছ রোপণের পরামর্শ দেন তিনি। একটি গাছ কীভাবে খাদ্যশৃঙ্খলসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করছে, তা–ও তুলে ধরেন। অনেকেই ফুল-ফলের ছবি পাঠিয়ে এর প্রকৃত পরিচয় জানতে চান।

আজহারুল ইসলামের করা কোনো ভিডিও ২৪ ঘণ্টায় ১০ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

গাছ নিয়ে কেউ কথা বলতে চাইলে আজহারুল ইসলাম বিরক্ত হন না। তিনি বলেন, ‘আমার ভিডিও দেখার পর অনেকেই মন্তব্যের ঘরে অনেকেই গাছ রোপণ করেছেন বলে জানান। অনেকে আবার অনেক কিছু জানতে চান। এসবই আমার ভালো লাগে। গাছ চেনানো আমার পেশা নয়, আমার নেশা।’

আজহারুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। তিনি তাঁর বাড়িতে নীল চাষের নীল গাছ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গাছ দিয়ে বাগান করেছেন। ভবিষ্যতে একটি নার্সারি করার পরিকল্পনার কথাও জানালেন তিনি।