দুই সন্তানকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ, বাঁচলেন না মা–ও

আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে নূর নাহার ও তাঁর বোনের ঘর। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ এলাকার পূর্ব শহীদ নগরে
ছবি: প্রথম আলো

এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে পোড়া কাপড়; আগুনে দগ্ধ আসবাব, রান্নার সরঞ্জাম ও মুঠোফোনের টুকরা। শনিবার রাতেও এখানে পরিপাটি ছিল ছয়টি কক্ষ। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিল ছয়টি পরিবার। কিন্তু রোববার ভোরে আগুনে ছাই হয়ে গেছে সব। প্রাণ হারিয়েছেন দুই সন্তানসহ এক মা। পাশে থাকা দোতলা ভবন আর নারকেলগাছ দেখে বোঝা যায়, আগুনের শিখা কতটা ভয়াবহ ছিল।

গতকাল সোমবার দুপুরে বায়েজিদ এলাকার পূর্ব শহীদনগরের ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় আহত ইমাম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি নিহত নূর নাহারের ভাইয়ের ছেলে। তিনি বলেন, ‘ভোর সাড়ে চারটার দিকে ফুফুর চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায় আমার। ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি, আগুন লেগেছে। আমি বাবা, মা আর অন্যদের ডাকতে শুরু করি। এর মধ্যেই ফুফু কখন আগুন লাগা ঘরে ঢুকে যান, তা টের পাইনি।’

রোববার ভোরে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে থাকা স্বজনদের চিৎকার করে ডাকতে থাকেন নূর নাহার বেগম (৩০)। এগিয়ে আসেন তাঁর ভাই, বোন ও স্বজনেরা। পাশের পুকুর থেকে পানি এনে আগুন নেভাতে চেষ্টা করেন তাঁরা। ঘুমন্ত দুই সন্তানকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দেন নাহার। দুই সন্তানের সঙ্গে আগুনে পোড়েন তিনি নিজেও।

রোববার ভোর পাঁচটার দিকে আগুনের খবর পেয়ে বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় দুই সন্তানসহ নূর নাহারকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নূর নাহার বেগম, তাঁর তিন বছরের মেয়ে ফারিয়া ও দেড় বছরের শিশু মারুফ।

জানা যায়, বায়েজিদ এলাকার পূর্ব শহীদনগরের স্থানীয় বাসিন্দা মো. দেলোয়ার নিজের ছয় মেয়ের বসবাসের জন্য তৈরি করে দেন এই কক্ষগুলো। বাঁশের বেড়ার ও টিন দিয়ে তৈরি এই কক্ষগুলোতে বসবাস করে আসছিলেন ছয় বোন ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। বোনদের মধ্যে নূর নাহার সবার ছোট। একেবারে শেষের ছোট কক্ষটিতে স্বামী মানিক মিয়া এবং তিন সন্তান—মো. মাসুদ, ফারিয়া ও মো. মারুফকে নিয়ে থাকতেন নূর নাহার। এ কক্ষেই দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন নূর নাহার বেগম, ফারিয়া ও মারুফ। পাশে খালার বাসায় থাকায় প্রাণে বেঁচে যায় সাড়ে পাঁচ বছরের মাসুদ।

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন মানিক মিয়া। সোমবার দুপুরে নগরের বায়েজিদ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পেশায় টেম্পোচালক নূর নাহারের স্বামী মানিক মিয়া ছিলেন কাপাসগোলা এলাকায় একটি গ্যারেজে। স্ত্রী ও দুই সন্তান হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। তাঁকে পাওয়া গেল পাশের মাজার এলাকায়। তিনি বলেন, আগের দিন রাতে টেম্পো ঠিক করতে গিয়ে দেরি হওয়ায় গ্যারেজেই ঘুমিয়ে পড়েন। বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় একজন তাঁকে মুঠোফোন খুদে বার্তায় জানায়, তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে যান তিনি। স্থানীয় মানুষ ও আত্মীয়রা থাকার পরও একজনও তাঁকে আগুনের খবর জানায়নি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এখন বড় ছেলে মাসুদই সম্বল তাঁর।

তবে নিহত নূর নাহারের ভাই মো. ইসমাইল বলেন, ‘নাহারের স্বামী প্রায়ই ঘরে থাকতেন না। একদিন আসতেন, একদিন আসতেন না। ঘটনার দিনও তিনি ছিলেন না ঘরে। তিনি থাকলে আমার বোন আর ভাগনে-ভাগনিকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার লিটন পালিত প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁরা মারা যান। নিহত তিনজনের শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ আগুনে পুড়ে গেছে। ইমাম উদ্দিনের শরীরের পুড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।