রিমান্ডফেরত অধ্যাপক আবুল বারকাতের প্রিজন ভ্যানের ভেতরে ১৫ মিনিট

প্রিজন ভ্যানের ভেতরে অধ্যাপক আবুল বারকাত। আজ সোমবার ঢাকার আদালত এলাকায়ছবি: আসাদুজ্জামান

দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল বারকাতের পরনে সাদা টি–শার্ট আর নীল রঙের একটি ট্রাউজার। পায়ে তাঁর চটি স্যান্ডেল। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানার দরজা খুলে আবুল বারকাতের ডান হাত ধরে বের করেন একজন পুলিশ সদস্য।

সময় তখন বিকেল ৫টা ৫০ মিনিট। আবুল বারকাতের মুখে মাস্ক। হাজতখানা থেকে বের হওয়ার পর তিনি যখন ঢাকার মহানগর আদালতের সামনের চত্বরে পৌঁছান, তখন এক শুভানুধ্যায়ী তাঁকে সালাম দেন। বলেন, ‘স্যার, কেমন আছেন?’ জবাবে আবুল বারকাত বলেন, ‘আমি ভালো আছি। তোমরা সাবধানে থেকো।’

এ কথা বলে আবুল বারকাত মাথা নিচু করে সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন। তাঁর হাতে কোনো হাতকড়া ছিল না। তবে তাঁর ডান ও বাঁ হাত ধরে রাখেন দুজন পুলিশ কর্মকর্তা।

পুরান ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক। পার্কের কাছে রাখা ছিল একটি নীল রঙের প্রিজন ভ্যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল বারকাত প্রিজন ভ্যানের ভেতরে। আজ সোমবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে
ছবি: আসাদুজ্জামান

অধ্যাপক আবুল বারকাতের দুই হাত ধরে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রিজন ভ্যানের কাছে নিয়ে যান। আবুল বারকাত তখন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে ঢুকে যান। এ সময় একজন শুভানুধ্যায়ী একটি পানির বোতল তাঁর হাতে তুলে দেন। আর জামাকাপড়ের একটি ব্যাগ তাঁকে দেন।

আবুল বারকাতকে যে প্রিজন ভ্যানে নেওয়া হয়, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বেশ কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী।

আবুল বারকাত তখন প্রিজন ভ্যানের লোহার ফাঁকের কাছে আসেন।

মাথা উঁচু করে শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলতে থাকেন, ‘তোমরা সবাই ভালো থেকো...।’

প্রিজন ভ্যানের ভেতরে যাওয়ার পর আবুল বারকাত তাঁর মাস্কটি খুলে ফেলেন। তখন দেখা যায়, তাঁর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ। চোখের নিচে কালি। আরও দেখা যায়, আবুল বারকাতের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মধ্যবয়স্ক একজন আসামি। তিনি আবুল বারকাতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

অধ্যাপক আবুল বারকাতকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে। আজ সোমবার ঢাকার আদালত চত্বরে১
ছবি: আসাদুজ্জামান

তখনো আবুল বারকাতের বেশ কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আবুল বারকাত তখন প্রিজন ভ্যানের জানালার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থাকেন।

তখন সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট। আবুল বারকাতকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানার দিকে রওনা হয়। অর্থনীতির এই অধ্যাপক তখন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।

প্রিজন ভ্যানটি মহানগর আদালতের চত্বর থেকে পুরান ঢাকার আজাদ সিনেমা হলের সামনে গিয়ে যানজটে পড়ে। আবুল বারকাত তখনো দাঁড়িয়ে ছিলেন রড ধরে। তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে চারপাশ দেখতে থাকেন। প্রিজন ভ্যানটি তখন কচ্ছপগতিতে এগিয়ে রায়সাহেব বাজার মোড়ের কাছে আনন্দ বেকারির সামনে গিয়ে থামে। পরে প্রিজন ভ্যানটি ঢাকার সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকে প্রবেশ করে। প্রিজন ভ্যানটি যখন সিএমএম আদালতের প্রধান ফটক হয়ে হাজতখানার সামনে যায়, তখন আরেকটি প্রিজন ভ্যান হাজতখানার ভেতর বের হতে থাকে। সে কারণে আবুল বারকাতকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি হাজতখানার সামনে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। আবুল বারকাতের যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী ঢাকার মহানগর আদালতের হাজতখানার সামনে ছিলেন, তাঁরা আবার ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানার সামনে আসেন। তখনো আবুল বারকাত প্রিজন ভ্যানের রড ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরপরই তিনি পানি পান করছিলেন।

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথা বলছেন অধ্যাপক আবুল বারকাত। আজ সোমবার ঢাকার আদালত এলাকায়
ছবি: আসাদুজ্জামান

সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে প্রিজন ভ্যানটি ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানার ভেতরে ঢুকে যায়। পরে প্রিজন ভ্যান থেকে নামেন আবুল বারকাত। দুজন পুলিশ সদস্য তাঁকে হাজতখানার ভেতরে নিয়ে যান। প্রায় ৪০ মিনিট আবুল বারকাত সিএমএম আদালতের হাজতখানায় ছিলেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁকে নিয়ে একটি নীল রঙের প্রিজন ভ্যান কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আবুল বারকাত তখনো প্রিজন ভ্যানের রড ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

দুর্নীতির একটি মামলায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল বারকাতকে দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। আজ সোমবার বিকেলে তাঁকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হয়। পরে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন আবুল বারকাতকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাতের আইনজীবী শাহিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আবুল বারকাতের জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করবেন।

প্রিজন ভ্যানের ভেতরে অধ্যাপক আবুল বারকাত। আজ সোমবার ঢাকার আদালত এলাকায়
ছবি: আসাদুজ্জামান

এর আগে গত বুধবার আবুল বারকাতের জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। একই দিন তাঁকে দুই দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছিলেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। ১০ জুলাই আবুল বারকাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অধ্যাপক আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে এননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি তিনিসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদক বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ও আবুল বারকাত পরস্পর যোগসাজশে জালজালিয়াতির মাধ্যমে এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন। আতিউর রহমান ও তাঁর সহযোগী অন্য ব্যক্তিরা বিভিন্ন অনৈতিক কৌশলে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।

আবুল বারকাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বিদায় নেন অধ্যাপক আবুল বারকাত। আজ সোমবার ঢাকার আদালত এলাকায়
ছবি: আসাদুজ্জামান