ডিজেলের নতুন উৎস পাওয়া যাচ্ছে না

সেচকাজে ডিজেল ব্যবহার করছেন কৃষক
প্রথম আলো ফাইল ছবি

দেশে ডিজেল আমদানির জন্য এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত করা যায়নি। ভারত রাশিয়ার তেল দিতে চাইলেও পরিমাণ কম। ব্রুনেই থেকে আপাতত আসছে না ডিজেল। কুয়েতও বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের ঋণপত্রে (এলসি) জ্বালানি সরবরাহে রাজি হচ্ছে না। এ অবস্থায় ডিজেলের নতুন উৎস মিলছে না।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে দুটি বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ডিজেল কেনার অনুমতি চেয়ে ১৪ ডিসেম্বর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সবকিছু চূড়ান্ত হলে দুটি কোম্পানি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে ডিজেল সরবরাহ করবে।

আরও পড়ুন

বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিজেলের নতুন উৎস খুঁজতে শুরু করে সরকার। আগ্রহী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথমে ১৫টি এবং পরে সাতটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে বিপিসি। পরে জ্বালানি বিভাগের পরামর্শে কোম্পানিগুলোর মালিকানা দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে দুটি কোম্পানিকে চূড়ান্ত করা হয়।

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় প্রতিনিধি স্পিড ইমপোর্ট এক্সপোর্ট অ্যান্ড কনসালটেন্সি লিমিটেডের মাধ্যমে প্রথমে প্রতি ব্যারেল (১৫৯ লিটার) ৬৫ ডলারে দুই লাখ টন সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল বেনেলাক্স ট্রেডিং। চূড়ান্ত আলোচনার পর দাম ৭১ ডলার নির্ধারণ করা হয়। আরেক প্রতিষ্ঠান প্রাইম স্টার এনার্জি গ্লোবাল এফজেসি প্রথমে প্রতি ব্যারেল ১০৬ ডলারে এক থেকে দেড় লাখ টন ডিজেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। আলোচনা শেষে ৯০ ডলার দাম ঠিক করা হয়। দুটি প্রতিষ্ঠানই আরব আমিরাতের। চিঠির বিষয়ে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জ্বালানি বিভাগ থেকে কোনো নির্দেশনা পায়নি বিপিসি।

বিপিসির দুই কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে ১০০ থেকে ২০০ টন ডিজেল কেনা হতে পারে। সরবরাহকারী কোম্পানির সক্ষমতা, ডিজেলের গুণগত মান বিবেচনা করে ভবিষ্যতে আরও কেনা হতে পারে।

বিপিসি বলছে, দেশে ব্যবহৃত বিভিন্ন জ্বালানির মধ্যে ৭৫ শতাংশই ডিজেল। আর ডিজেলের ৮০ শতাংশই আমদানি করা হয়। নতুন উৎস থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি তেমন লাভজনক হবে না। তাই ডিজেল আনতে চায় তারা। রাশিয়া, ব্রুনেই ও ভারতের সঙ্গে শুরুতে আলোচনা হয়েছে। রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি দেশে পরিশোধনের উপযোগী নয় বলে ইতিমধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। তাদের কাছ থেকে সরাসরি ডিজেল সরবরাহের প্রস্তাব চাইলেও এখনো তারা কিছু জানায়নি।

রাশিয়ার তেল দিতে চায় ভারত

ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডের (আইওসিএল) সঙ্গে ডিজেল আমদানির আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। গত সেপ্টেম্বর থেকে তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়। তারা রাশিয়ার তেল সরবরাহের কথা বলেছে। তবে রাশিয়ার জ্বালানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামলাতে হবে বাংলাদেশকে। এ শর্তের কারণে কিছুটা তাদের ডিজেল আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

তবে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই আইওসিল থেকে ডিজেল কেনার বিষয়ে চুক্তি হবে। ওই ডিজেল কোন দেশের অপরিশোধিত তেল থেকে শোধন করা হচ্ছে, তা বিপিসির জানার কথা নয়।

বর্তমানে ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আনে বিপিসি। ২০১৭ সাল থেকে ট্রেনে আসছে এ তেল। তবে বছরে এই তেলের পরিমাণ ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টনের বেশি নয়। এ পরিশোধনাগার থেকে তেলের পরিমাণ বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন। গত জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো হয়নি।

ব্রুনেইয়ের তেল অনিশ্চিত

এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্র ব্রুনেই থেকে ডিজেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আনতে জ্বালানি সহযোগিতায় একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার। এই দেশটির বড় ক্রেতা জাপান। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডও তাদের জ্বালানি কেনে। দেশটির একমাত্র পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বেশি না থাকায় ডিজেল রপ্তানির পরিমাণ কম। তাই বাংলাদেশকে কিনতে হলে অন্তত আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, আগে থেকেই তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের ক্রয়াদেশ জমা আছে।

স্থানীয় ব্যাংকে আস্থা নেই কুয়েতের

ডিজেল কিনতে কুয়েতের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ করছে বিপিসি। তবে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের ঋণপত্রে তেল সরবরাহে রাজি নয় কুয়েত। তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক ব্যাংকের ঋণপত্র দিতে হবে অথবা তেলের দাম আগাম পরিশোধ করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ডলার-সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতা চলছে। সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে বিলম্বে বিল দেওয়ার শর্তে জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রস্তাব দিচ্ছে। বিপিসির আর্থিক সক্ষমতাও কমছে। বর্তমানে তহবিলে আছে ২০ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এতে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে। তাই কেউ দাম কমাতে চায় না। ‘এক দাম’ বলে আলোচনা থামিয়ে দেয় অনেক কোম্পানি।

উৎস বেশি হলে প্রতিযোগিতামূলক দাম

আগামী ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) জ্বালানি তেলের চাহিদা আগের চেয়ে বাড়বে। তাই বাড়তি ডিজেল আমদানি করতে হবে। আগামী কৃষি সেচ মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-মে) ডিজেল লাগবে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ১২৯ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছিল ১১ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ টন। এ ছাড়া আগামী জুনে দেশে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহের মূল কেন্দ্র সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উদ্বোধন করা হচ্ছে। এটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে বাড়তি জ্বালানি লাগবে।

বাড়তি পরিশোধন ও মজুত সক্ষমতা না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বেশি তেল কিনে মজুত করতে পারছে না বিপিসি। কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের একমাত্র পরিশোধনাগারের সক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। সক্ষমতা বাড়ানোর একটি প্রকল্প ১২ বছর ধরে ঝুলে আছে।

বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রুনেইয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা এখনো ডিজেল সরবরাহে প্রস্তুত নয়। রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে কোনো আলোচনা হয়নি। তারপরও সরবরাহে ঘাটতি হবে না। আগামী ছয় মাসের জন্য কিছু ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে। আরেকটি অংশ ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সাশ্রয়ের চিন্তা করেই জ্বালানি তেলের বহুমুখী উৎস খোঁজা শুরু হয়। বেশি উৎস থাকলে প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়া যায়।