খেলার মাঠটা কি ভাগ হয়ে যাবে

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দুটি বিদ্যালয়ের যৌথ মাঠ দ্বিখণ্ডিত করার প্রতিবাদে এক শিক্ষকের অনশন। আপাতত কাজ বন্ধ।

দুটি বিদ্যালয়ের যৌথ মাঠের মাঝে দেয়াল তোলার জন্য গর্ত করা হয়েছে। গত শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ইউনিয়নে
ছবি: প্রথম আলো

শুক্রবার বেলা তিনটা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগাহাট আবদুর রউফ (এআর) মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয় ও দারোগাহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যৌথ মাঠে চার-পাঁচটি শিশু ফুটবল খেলছিল।

তখন আরও ১০টি শিশু-কিশোর মাঠের পাশে সড়কে অপেক্ষা করছিল, তপ্ত রোদ কিছুটা কমার জন্য। এরপর তারা খেলাধুলা করতে মাঠে নামবে। কিন্তু এই শিশুদের মন ভালো নেই। কারণ, তাদের খেলার মাঠের ঠিক মাঝবরাবর দেয়াল নির্মাণ শুরু করেছে প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে মাঠটি দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে।

শুধু শিশু-কিশোরেরা নয়, এলাকার বাসিন্দারাও চান না মাঠটি দ্বিখণ্ডিত হোক। এই মাঠ ছাড়া আশপাশের বিদ্যালয়ে খেলার জন্য বড় কোনো মাঠ নেই। তা ছাড়া ওই মাঠে শুধু খেলাধুলা নয়, সামাজিক ও ধর্মীয় অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।

কিন্তু ২২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১০০ ফুট প্রস্থের এই মাঠ রক্ষায় প্রকাশ্যে কেউ আন্দোলনে নামেননি, কেবল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন নিজামী ছাড়া। তিনি একাই আন্দোলন করে যাচ্ছেন। দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরুর প্রতিবাদে অনশনে বসেন অবসরে যাওয়া এই শিক্ষক। দুই দিন অনশনে থাকার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদাত হোসেনের আশ্বাসে অনশন ভাঙেন তিনি।

২৩ জুলাই মাঠ দ্বিখণ্ডিত করতে দেখে এর প্রতিবাদে পরদিন তিনি মাঠের পাশে একটি দোকানে অনশনে বসেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ও তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা তাঁকে সমর্থন জানালেও ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে আসেননি।
রুহুল আমিন নিজামী, আবদুর রউফ (এআর) মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক

গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্ব পাশে উচ্চবিদ্যালয় ও পশ্চিম পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাঠের মাঝবরাবর দেয়াল নির্মাণের জন্য পিলার তৈরির কাজ চলছে। মাঠের মধ্যে রাখা হয়েছে ইট–বালু।

সেখানে কথা হয় দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাতুল আলম ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৌরভ হোসেনের সঙ্গে। তারা জানাল, বিকেল হলেই তারা ওই মাঠে খেলাধুলা করে। কিন্তু মাঠের মাঝখান দিয়ে দেয়াল তোলায় তাদের মন খারাপ। তাদের মাঠটি ছোট হয়ে যাবে। আর খেলার পরিবেশ থাকবে না। তখন কীভাবে তাদের বিকেলবেলাটা কাটবে?

স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্কুলে একটি ভবন নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এ জন্য প্রাথমিকের কর্তৃপক্ষ আগেই তাদের জায়গা বুঝে নিতে চায়।

একাই আন্দোলনে

আবদুর রউফ (এআর) মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন নিজামী জানালেন, স্কুল থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি। ১৯৯৬ সালে তিনি এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হন প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। ২০০৪ সালে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে স্কুলটি এমপিওভুক্ত হয়। উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে এমপিওভুক্ত হয় ২০০৬ সালে। এরপর তিনি অবসরে যান।

রুহুল আমিন নিজামী প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ জুলাই মাঠ দ্বিখণ্ডিত করতে দেখে এর প্রতিবাদে পরদিন তিনি মাঠের পাশে একটি দোকানে অনশনে বসেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ও তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা তাঁকে সমর্থন জানালেও ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে আসেননি। তিনি বিষয়টি ইউএনওকে জানান। ইউএনওর নির্দেশে কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ২৭ জুলাই তিনি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম নগরে চলে যান। ২৮ জুলাই খবর পান, ইউএনওর নির্দেশ অমান্য করে সেখানে পুনরায় কাজ চলছে। এতে তাঁর মন খারাপ হয়। কারণ, মাঠ যদি রক্ষা না পায়, তাহলে এলাকার ছেলেমেয়েদের মেধার বিকাশ ঘটবে না।

মূলত দুটি কারণে তাঁরা মাঠের মাঝখানে দেয়াল নির্মাণ করছেন। প্রথমটি হলো উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি তাদের নতুন ভবন পূর্ব-পশ্চিম বরাবর নির্মাণ করে, সে ক্ষেত্রে মাঠে তাঁদের অংশের অন্তত ১০ ফুট জায়গা ছাড়তে হবে।
আতিকুল ইসলাম, দারোগাহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক

দুই প্রধান শিক্ষক যা বলছেন

দারোগাহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মূলত দুটি কারণে তাঁরা মাঠের মাঝখানে দেয়াল নির্মাণ করছেন। প্রথমটি হলো উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি তাদের নতুন ভবন পূর্ব-পশ্চিম বরাবর নির্মাণ করে, সে ক্ষেত্রে মাঠে তাঁদের অংশের অন্তত ১০ ফুট জায়গা ছাড়তে হবে। এতে তাঁদের মাঠ ছোট হয়ে যাবে। এ জন্য আগেই তাঁরা দেয়াল নির্মাণ করছেন। দ্বিতীয়ত, তাঁদের শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য দোলনাসহ খেলনা কেনার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। মাঠে তাঁরা সেগুলো স্থাপন করতে চান। মাঠ যেহেতু উন্মুক্ত রয়েছে, তাই খেলনা নিরাপদ করতে দেয়াল নির্মাণ করছেন।

আতিকুল ইসলাম জানান, এই দেয়াল নির্মাণের জন্য ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষা কর্মকর্তার পরামর্শে ক্ষুদ্র মেরামত প্রকল্প থেকে দুই লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

অন্যদিকে বড় দারোগাহাট এআর মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মাঠের মাঝবরাবর স্থানীয় বাসিন্দারা যাতায়াত করেন। রাতে মাঠে স্থানীয় লোকজনের আনাগোনা হয়। এ অবস্থায় প্রাইমারি কর্তৃপক্ষের মাঠ নির্মাণে তাঁরা আপত্তি করছেন না।

তবে স্থানীয় একটি সূত্রের ভাষ্য, মাধ্যমিকের প্রধান শিক্ষকের এই বক্তব্যের সঙ্গে ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকদের অনেকেই একমত নন।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুচ্ছোফা বলেন, প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারদিকে সীমানাদেয়াল নির্মাণ করার সরকারি নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু এই বিদ্যালয়ের তিন পাশে দেয়াল থাকলেও এক পাশে নেই। এ জন্য তাঁরা দেয়াল নির্মাণ করছেন। আপত্তি আসায় আপাতত নির্মাণকাজ স্থগিত রয়েছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জানিয়েছেন, ভবন নির্মাণের কারণে যদি মাঠ ভাগ হয়ে যায়, তাহলে এমন কোনো প্রকল্প বড় দারোগাহাট এআর মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়কে দেওয়া হবে না।

জানতে চাইলে সীতাকুণ্ডের ইউএনও মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, গত ২৬ জুলাই থেকে আর কোনো কাজ সেখানে হয়নি। কেবল মানুষ চলাচলের যে রাস্তা রয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাইমারি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পকেট গেট তৈরি করতে বলা হয়েছে। মাঠ কোনোভাবে দুই ভাগ হতে দেওয়া হবে না।